Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

হিল ট্যুরিজম: পাহাড়ী জীবন ও সংস্কৃতিতে পর্যটনের সম্ভাবনাময় ধারা

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বার ২০২১, ০২:৫৩

মোঃ মিরাজ হোসেন: সংস্কৃতি বলতে সাধারণ অর্থে মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণ, ব্যবহার, ধর্ম, জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিক কার্যক্রম কে বোঝায়। রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিচিত্রতা নিয়ে আসে সংস্কৃতি। সকল দেশের মানুষই তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চায় বিশ্বের পর্দায়। তাদের উৎসব উদযাপনে আমন্ত্রণ জানায় অন্যদের, নিজেদের বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে জানান দিতে চায় পুরো বিশ্বকে।

বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর আয়তনের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হলেও পেয়েছিল এক বিচিত্র সংস্কৃতি। বিচিত্র সংস্কৃতি দিয়েই ধীরে ধীরে পৃথিবীতে জানান দিয়েছিল নিজের অস্তিত্বের, বাঙালি জাতিসত্তার এবং আমাদের সোনার বাংলার। বারো মাসে তের পার্বণ উদ্‌যাপন করা বাঙালির জীবনে সংস্কৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশে সমতল ভূমি, পাহাড়, নদ-নদী এসবকে ঘিরে ঘড়ে উঠেছে নতুন জাতি, উপজাতি যাদের ভাষা, আচার আচরণ, ধর্ম, বর্ণ, খাবারে রয়েছে নিজস্বতা ও বিচিত্রতা।

বাংলাদেশ একটি সমতল ভূমির দেশ হলেও শুধুমাত্র দক্ষিণ পূর্বে চট্টগ্রামে পাহাড়, উত্তর পূর্বে সিলেটে নিচু পাহাড় এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে উচ্চভূমি আছে। এসবের মধ্যে অন্যতম পাহাড় সমূহ হচ্ছে সাকা হাফং, তাজিংডং, মোদক মুয়াল, দুমলং, কেওক্রাডং ও জোগি হাফং।

জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে অনুসারে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৫টি এবং এদের বেশিরভাগই পাহাড়ে বসবাস করে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস ও উৎসব। এই পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আদিম সভ্যতা। তখন ছিল না ঘর, সবাই বাস করতো পাহাড়ের গুহায়। গায়ে ছিল না আজকালের আধুনিকতার ছোঁয়া।

এই ধারাগুলো আজও রয়ে গেছে আমাদের দেশের পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে। আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, ম্রং, সাঁওতাল, রাখাইন, মনিপুরি এসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাদের অতি সাধারণ জীবনযাপন, কাঠের ঘর, মসলা বিহীন খাবার, পোশাক, সমতলের মানুষদের মনে তৈরি করে কৌতূহল।

তাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসব। প্রতিবছর বাঙালি বর্ষ বরণের সাথে তারাও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৈসাবি উৎসব পালনের মাধ্যমে বছর শুরু করে। এছাড়াও চাকমাদের ৩ দিন ব্যাপী বিজু উৎসব, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরাদের বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যাদের বৈসুক, মুরংদের চাংক্রান, সাঁওতালদের সহরায় উৎসব জীবনে যুক্ত করে রোমাঞ্চিত ধারা।

মানুষের নতুনকে জানা ও ঘুরে দেখা, ব্যবসায় কিংবা ধার্মিক প্রয়োজনের ধারণা থেকেই সৃষ্টি পর্যটন শিল্পের। এই শিল্পের মোট ৪০% পর্যটক আসে কালচার বা সংস্কৃতি কে জানতে, ঘুরে দেখতে এবং নতুন কিছু শিখে নিতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন স্পেন, ব্রাজিল, চায়না, মেক্সিকো সহ আমাদের পাশের দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটান তাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করতে পারছে যেদিক থেকে বাংলাদেশেরও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।

বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় পাহাড় ও পাহাড়ী সংস্কৃতি খুলে দিয়েছে এই বিপুল সম্ভাবনা দ্বার। একটি বা দুটি নয়, রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পশ্চিমা দেশের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের মতন ধারা, জনপ্রিয় হতে পারে আদিম যুগের মতো তাঁবু গেড়ে রাত্রি যাপন করা, পাহাড়ী অতিসাধারণ জীবনযাপন হতে পারে মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। গড়ে উঠতে পারে পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে বেয়ে উঠা ট্র্যাকিং, রাফটিং, জিপলাইনিং, বাইকিং, হাইকিং, সাইক্লিং ও পাহাড়ের ঢলে বেয়ে চলা নদীতে কায়াকিং এর মতন নতুন নতুন ট্রেন্ড বা ধারা।

বর্তমানে আমাদের দেশে পাহাড় ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সমতলের মানুষ যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে নিতে চায় মুক্ত আকাশের ছোঁয়া। এই স্বাদ নিতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ ছুটে যাচ্ছে পাহাড়ে। এই সুযোগ কে কেন্দ্র করে পাহাড় হয়ে উঠতে পারে অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির নতুন এক দিগন্ত, চাকা ঘুরে সবল হতে পারে পাহাড়ী মানুষদের জীবন।

জীবনযাপনের জন্যে গতানুগতিক কৃষি কাজ বা জুম চাষ ছাড়াও তাদের জন্যে এই পর্যটন কে ঘিরে রয়েছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা। ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের তারা নিজেদের ঘর ভাড়া দিয়ে হোম স্টের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে, এছাড়াও আদিবাসী খাবার কে তুলে ধরতে পারে উন্মুক্ত বিশ্বের কাছে। ক্লান্ত পর্যটক যখন সন্ধ্যায় তাদের ঘরে আসবে বিশ্রাম নিতে, তখন সুযোগ রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরে বিনোদন দেওয়ার মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আয়ের। শিক্ষিত যুবকেরা হয়ে উঠতে পারে ট্যুর গাইড, দিতে পারবে পর্যটকদের ভ্রমণ সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা এবং কথার ভাজে তুলে ধরতে পারবে তাদের জাতিসত্তার ইতিহাস কে। এছাড়াও ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের সহায়তাকারী সরঞ্জাম ভাড়া দেয়ার মতন সুযোগ তো আছেই। হাজার বছরের এই মাটির স্তূপকে ঘিরেই রয়েছে হাজারো সুযোগ, রয়েছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি, শুধু প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনার।

আমাদের দেশে যে পাহাড় কে ঘিরে পর্যটন গড়ে উঠেনি বিষয় টা এমন নয়। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে কেউ ফিরে এসেছে হাসি মুখে ভ্রমণ স্মৃতি নিয়ে কেউ বা অবসন্নতা ও ক্লান্তি নিয়ে। পাহাড়ী পর্যটন কে ঘিরে সুযোগ সম্ভাবনার চেয়ে সমস্যাই বোধ হয় বর্তমানে বেশি পাওয়া যাবে। পাহাড়ে ভ্রমণের মুল সমস্যা হল যাতায়াত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঘিরে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা গগন চুম্বী পথ মেঘের দিকে টানলেও তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে বিপদ, প্রতি বছর হাজারো দুর্ঘটনা হয় এই পথে। এছাড়াও কিছু অসাধু মানুষের পাহাড় কেটে ফেলার কারণে বর্ষার মৌসুমে হয় পাহাড় ধস, বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা।

নিরাপত্তার ব্যবস্থার বাধার কারণে যাওয়া যায় না অনেক স্থানে। এরই মাঝে রয়েছে খাবার, নিরাপদ রাত্রিযাপন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব। অপ্রতুল স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণেই নারী পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকার বাইরে চলে যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এসব স্থান। এসব বহুমুখী সমস্যার কারণে শুধু মাত্র যুবক শ্রেণীর পর্যটকদের নিকট স্থান করে নিতে পেরেছে এই পাহাড় ভ্রমণ বা হিল ট্যুরিজম।

হিল ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। প্রথমেই সুগম করতে হবে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যার ফলে পর্যটকরা ছুটে আসতে পারে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে। যান্ত্রিক ছোঁয়া শুধু শহরেই মানায়, পাহাড় কে রাখতে হবে সবুজ। বন্ধ করতে হবে পাহাড় কাটা। নিরাপত্তার চাদরকে বিস্তৃত করে আনতে হবে। তৈরি করতে হবে গণসচেতনতা, যাতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা স্বাগত জানাতে পারে সমতলের মানুষদের।

পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট উপায়ে করতে হবে প্রচার প্রচারণা। ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা টুইটারের মাধ্যমে পাহাড়ি সংস্কৃতির প্রচার হতে পারে পর্যটকদের জন্যে আমন্ত্রণ বার্তা। তাদের উৎসব কে কেন্দ্র করে ট্যুর অপারেটররা দিতে পারে আকর্ষণীয় প্যাকেজের অফার। নারী পর্যটকদের আকর্ষণে বাড়াতে হবে স্যানিটেশন ব্যবস্থার, দিতে হবে নিরাপদ রাত্রি যাপনের সুযোগ। নির্মূল করতে হবে পর্যাপ্ত সুপেয় পানির অভাব। পর্যটক ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী উভয়কেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে হোম স্টে সম্পর্কে, যাতে চাঁদের নির্মল আলোতে জ্যোৎস্না রাতে আকাশের তারা গুনে ক্লান্তি দূর করা যায়। তবেই সম্ভব হবে হিল ট্যুরিজমের মাধ্যমে পর্যটনে সমৃদ্ধি ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি।

তথ্যসুত্রঃ
১। বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠী, উইকিপিডিয়া
২। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ
৩। আদিবাসীদের কয়েকটি উৎসব, জাহিদুল হক, ডি.ডাব্লিউ মিডিয়া সেন্টার
৪। The European market potential for cultural tourism, CBI, Ministry of Foreign Affairs, Netherlands

লেখক: মোঃ মিরাজ হোসেন
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা, ২৬ সেপ্টেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমজেড


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ