শারমিন রহমান, জাবি : মতিন মিঞা। বন্ধু মহলে ডিজে মতিন নামে বেশ পরিচিত। পড়াশোনা করছেন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তার এ চলার পথ সহজ নয়। তার চারপাশ অন্ধকার। তবুও আলোকিত হচ্ছেন তিনি মনের আলোয়।
জন্মগতভাবে দুই চোখেই তার আলো নেই। তবুও তিনি দমে যাননি।
জাবিতে সফলতার সঙ্গে তিনটি বছর শেষ করে এখন আছেন ইতিহাস বিভাগের ৪র্থ বর্ষে। শুধু পড়াশোনা নয় সাংস্কৃতিক পরিমলেও রয়েছে মতিনের পদচারণা। মতিন ভাল বাঁশি ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন, দখল আছে গানের ভুবনেও।
অসম্ভব প্রতিভাধর মতিনের জন্ম ১৯৯৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর থানার আশরাফবাদ গ্রামে।
বাবা মো. আলী মিঞা এবং মা নূরজাহান বেগমের চার সন্তানের মধ্যে মতিন তৃতীয়। ছোটবেলা থেকে উঠানই ছিল তার বিচরণ ক্ষেত্র। সমবয়সীরা যখন স্কুলে দূরন্তপনায় তখন মতিনকে বাড়িতে বসে স্বপ্ন বুনতে হয়েছে।
পিতার আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় জন্মগতভাবে অন্ধ মতিন ছেলে বেলার সেই সময়টায় স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। তবে অর্থ জ্ঞান পিপাসু মতিনকে আটকে রাখতে পারেনি। বোন যখন পড়তে বসতেন মতিন তখন পাশে বসে পড়া শুনতেন আর মুখস্ত করতেন। পড়াশোনার প্রতি এই আগ্রহের কথা শুনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাকে ২০০০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়।
পড়াশোনা এবং থাকা খাওয়ার যাবতীয় খরচ বহন করত একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ওই বিদ্যালয় থেকেই ২০১০ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর ভর্তি হন ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌর ডিগ্রি কলেজে। আর্থিক খরচ মেটাতে না পারায় লেখাপড়া যখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন মতিনের সাহায্যে এগিয়ে আসে ডাচ বাংলা ব্যাংক। ওই কলেজ থেকেই মতিন ২০১২ সালে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আগে মতিনকে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অর্থের অভাবে কোচিংও করা হয়নি মতিনের।
তবে যে পরিশ্রম করতে জানে ভাগ্য তাকে নিরাশ করে না। ঠিক তেমনই প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় পরিশ্রমের ফলাফল পান। এক শুভাকাঙ্খী মতিনকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি গাইড রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়। ওই রেকর্ডের সূত্র ধরেই মতিন ভর্তির সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেও তিনি চান্স পান। তবে তিনি ভর্তি হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও মতিনকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। মতিন যখন স্যারদের দেয়া ডজন ডজন বইয়ের লিস্টের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন তার সাহায্যে এগিয়ে আসে একই বিভাগের মেহেদী হাসান। তিনি তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। কখনো মেহেদীর সাহায্যে টেপ রেকর্ড করে কখনো বা ব্রেইল পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে, এভাবেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন মতিন।
বর্তমানে মতিনকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে ডাচ বাংলা ব্যাংক এবং পিডিএফ নামক একটি সংগঠন।
উল্লেখ্য, মতিন পিডিএফের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তার মত প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাঁশির সুরে মুগ্ধ করতে বন্ধু মহলে জনপ্রিয় মতিনের জুড়ি নেই।
বন্ধুদের আবদার মেটাতে মাঝে মাঝে বাঁশি বাজিয়ে শোনান তিনি। মতিন একবার করে ব্র্যাক বিশ্বদ্যিালয়ে এবং জাবির মুক্তমঞ্চে স্টেজ শোতে দর্শকদের বাঁশি বাজিয়ে শুনিয়েছেন। গেল ঈদে ইত্যাদিতে বাঁশি বাজিয়েছেন তিনি। মতিনের স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে সমাজের সুবিধা বঞ্চিতদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চান অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করা এ মানুষটি।
ঢাকা, ০৯ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//জেএন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: