Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

আমলাতন্ত্রের আভিজাত্য নয়, সাধারণ মানুষের অসাধারণ ম্যাজিস্ট্রেটের গল্প

প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০১৭, ১৭:৫৭

শেখ আদনান ফাহাদ : ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশে তিনি জীবনযাপন করতে পারতেন, এখনো পারেন। কত উচ্চ শিক্ষিত, দক্ষ বাংলাদেশী দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে স্বস্তির জীবন বেছে নিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কোনো কিছুতেই ইতিবাচকতা খুঁজে না পাওয়ার মানসিকতা, ‘উন্নত’ জীবনের হাতছানির মহামায়াকে পাশ কাটিয়ে দেশে থেকে সমাজ বদলের চেষ্টা করেন কয়জন? সবাই একরকম নন। এমনি ব্যতিক্রম একজনের গল্প এখন ফেসবুকের পাতায় পাতায়।
খুবই অনুপ্রেরণাদায়ী এক তরুণের গল্প লিখতে বসলাম আজ। গল্প না ঠিক, বাস্তব। একজন বিচারপতি আমাকে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা’ বলে যে অর্থ বাংলাদেশে প্রচলিত আছে সেটি আসলে দুর্নীতিগ্রস্থ ও ফাঁকিবাজদের জন্য, ‘ক্ষমতা’ মানে হল শুধু কাজ করে যাওয়া, নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার নামই প্রকৃত অর্থে ‘ক্ষমতা’। প্রশাসনিক এখতিয়ারকে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে পুরোপুরি কাজে লাগালে কীভাবে সমাজে ইতিবাচক কম্পন সৃষ্টি করা যায় তারই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। নাম তাঁর সোহেল রানা।

সম্প্রতি একটা ঘটনা, আসলে দুর্ঘটনা, গণমাধ্যমে খুব বেশী গুরুত্ব পায়নি। গত ৮ মার্চ ফেনীর সীমান্তে চোরাকারবারি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের হামলায় আনসার সদস্য নওশের আলী মারা যায়। নওশের আলীর লাশ পড়েছিল ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে! বিএসএফ পরে সেই লাশ হস্তান্তর করতে সম্মত হয়! সেই হামলায় আহত হন ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গিয়েছিলেন সোহেল রানা। সাথে ছিল পুলিশ, আনসার। এবং সেটা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মাটিতে। তাহলে কীভাবে নওশের আলীর লাশ ভারতের মাটিতে পড়ে থাকল? পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, দুইদেশের মাদকব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এই হামলা হয়েছে। একজন মারা গেছে, কয়েকজন নিখোঁজ ছিলেন।

এতবড় একটা বিষয়, কিন্তু আমাদের গণমাধ্যম এটা নিয়ে তেমন কিছু প্রচার করলনা। সাদামাটা একটা নিউজ করেই দায়িত্ব পালন করেছে। ফলোআপও কেউ করেনি। অথচ সেদিনের হামলায় ভারতীয়-বাংলাদেশী মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারত।

সোহেল রানা বেঁচে গেছেন, কিন্তু নওশের আলী মারা গেছেন। আমাদের ঢাকা-কেন্দ্রীক মিডিয়া হয়তো ভেবেছে, ম্যাজিস্ট্রেটতো আর মারা যায়নি! একজন আনসার সদস্য আর কী ইম্পরট্যান্ট!

ভারত-বাংলাদেশের মাদকব্যবসায়ীদের হামলায় সোহেল রানা মারা যেতে পারতেন। কারণ রাতের অন্ধকারে তাকে মেরে ফেলতে কুপানো শুরু করেছিল মাদক সন্ত্রাসীরা। কোনোমতে প্রাণ হাতে নিয়ে সেদিন বেঁচে ফিরেছেন সোহেল রানা। সোহেল রানা সেখানে যাবেন, এমন তথ্য কি আগে থেকেই মাদক চোরাচালানীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল? না হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে ভারতীয় সন্ত্রাসীরা কীভাবে হামলা চালাল? নওশের আলীর লাশ কীভাবে ভারতের মাটিতে পড়ে রইল? আশা করি সরকার পুরো বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পুরো মনযোগ দিয়ে তদন্ত করে দেখবে। আমার মনে হয়, সোহেল রানা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের টার্গেটে ছিলেন।

সোহেল রানা এই বীরত্বপূর্ণ অভিযান কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ফেসবুকের মাধ্যমে জানলাম, উনার নাকি এরকম দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করা নিয়মিত বিষয়। আমার মনে হয়েছে, উনি প্রশাসন ক্যাডারের কাজকে শুধু চাকরি হিসেবে নেননি। উনার অনেক ভক্ত আছে। এবং তারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে, ছবি দিয়ে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছেন।

যেমন সাংবাদিক শরিফুল হাসান লিখেছেন, ‘প্রিয় সোহেল রানা, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ সরকার তোমার মতো কর্মকর্তার পাশে থাকবে। আর কেউ না থাকলেও নীতির সাথে তো আপোষ করা চলে না। তোমার জন্য শুভকামনা। নষ্ট এই দেশটা ঠিক করার লড়াইয়ে আমার মতো বোকার সংখ্যায় আরও একজন আছে জেনে ভালো লাগলো। ভালো থেকো প্রিয় ভাই আমার। পাশেই আছি। শুভকামনা সবসময়’।

সুমন হাসান নামের একজন লিখেছেন, ‘সময়টা বেশিদিন আগের নয়। ২০১৬ সালের ২২ মার্চ ফেনী জেলা প্রশাসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন সোহেল রানা। মেধাবী, সাহসী, এবং আত্মবিশ্বাসী তরুণ এই ম্যাজিস্ট্রেট ফেনীতে এসেই আলোচনার ঝড় বইয়ে দেন। সর্বক্ষেত্রেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন তিনি। মাঝখানে দীর্ঘদিন বিরতি। ৬ মাসের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ফেনী ছাড়েন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে আবার কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন।

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ফেনীর বিপদগামী মানুষের কথা চিন্তা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একের পর এক মাদক আস্তানা গুড়িয়ে দিয়ে অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেন তিনি। বিদ্যালয়ে মেয়েদের নির্বিঘ্নে যাতায়াত নিশ্চিত করতে, ছদ্মবেশে স্কুলের সামনে অবস্থান করে, বখাটেদের আটক করেন তিনি’।

আমি ফেসবুক থেকে এও জানলাম যে, পার্কে স্কুল-কলেজ চলাকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত নিষেধ করেন তিনি। সোহেল রানা নিজেকে আমলাতন্ত্রের আভিজাত্যের চারদেয়ালের জীবন থেকে বাইরে আনতে পেরেছেন। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পাওয়া সহজ কথা নয়। এমনকি তার টিমের আনসার সদস্য কতখানি তাঁকে ভালোবাসতেন! তাকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন নওশের আলী। আমাদের দুর্নীতিপরায়ণ সমাজে এমন একটি ঘটনা আমাদেরকে অনেক সাহসী করে তোলে। সবাই যখন এমন সোহেল রানা আর নওশের আলীদের মত হয়ে উঠবেন তখনই সত্যিকারের সোনার বাংলা নির্মাণ সম্ভব হবে।

সোহেল রানার কাছে একটা অনুরোধ থাকবে, আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যাবেন। আর রাষ্ট্রের কাছে আমাদের বিনীত, সোহেল রানা, নওশের আলীদের যতভাবে পারা যায়, সহযোগিতা করুন। অনেক খুঁজেও নওশের আলীর একটা ছবি পাইনি। ইচ্ছে ছিল নওশের আলী আর সোহেল রানা দুইজনের ছবি পাশাপাশি নিয়ে দেখব।


লেখক : শেখ আদনান ফাহাদ
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা, ১৬ মার্চ (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//জেএন


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ