তানভীরুল ইসলামঃ শরৎকাল চলছে অথচ গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। খাঁ খাঁ করছে চারদিক।এসময়ে কোনকিছু ভালো লাগে নাহ। আমারা যা পেতে চাই তাকেই ভালো বলি।প্রতিটি বিষয়েরই একটি নিজস্ব ভালো দিক থাকে।ভালো কেন লাগে তার নির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় কি আদৌও?
এসব ভাবতে ভাবতেই কফি ভর্তি মগে চুমুক। দিলরাজ, দিলরাজ বলে ডাক আসলো কানে, তারপর আর কোন সারা শব্দ নেই। বাবা ডেকেছিলেন হয়তো। নানু রেখেছেন নামটি "দিলরাজ"...
দিলরাজ অর্থ - one who rules on the hearts.. নামের অর্থের সাথে চরিত্রের মিল খুব একটা নেই। ঘন কালো বাবরি চুল, হালকা দড়ি গজিয়েছে। উচ্চতা পেয়েছি বাবার কাছে।
আজ প্রচন্ড মাথা ধরেছে। ডা. আদিত্যের ট্রিটমেন্টে আছি। তিনি এসময়কার সবচাইতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তবুও মাথা ব্যাথা কমার কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। কফির মগটি এখনো হাতে তবে কফি শেষ। রাবেয়া খালা কফি সাথে কিছু টোস্ট দেয়ে গেছেন।
কোন ব্রান্ডের টোস্ট তা বলতে পারবো নাহ, তবে খেতে দারুন লাগছে। আমার জন্মের আগ থেকেই তিনি আমাদের বাসায় কাজ করছেন।তাকে কাজের লোক মনে হয় নি কখনো। বয়স পঞ্চাশোর্ধ হবে, চুল আধপাকা। কপালে তার অদ্ভুত এক তিল। এক মায়াবী স্বভাবের মানুষ। মহান আল্লাহ কিছু মানুষকে অনেক মায়া মমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন এ পৃথিবীতে। আমার প্রতি এক মমতাময়ী ভালোবাসা তার। যেন তারই মাতৃগর্ভে জন্ম হয়েছিল আমার।
এ ছুটির দিনগুলোতে বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। সূর্যোদয় কতোদিন আগে দেখেছি তা জানা নেই আমার। সকাল হয়েছে, কাচের জানালা দিয়ে সূর্যের আলোয় রুমের অন্ধকার কেটে গেছে , তবুও শুয়ে আছি। হালকা ঘুমের মাঝে কিছু একটা শুনতে পেলাম , কেউ ডাকছে। তারপর আরও কয়েক দফায় ডাক চললো।
--মায়াবী কন্ঠে বলছে, "দিলরাজ বাবা, উঠে পরেন, সকাল হয়ি গেছেগা। আপায় রাগ করবো। নাস্তা রেডি হইছে, মুখ ধুইয়া খাইতে আসেন" – বুঝতে পারলাম রাবেয়া খালা ডাকছেন।
ঘুমের মধ্যেই বললাম-"খালা আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে রাখো।"
--"আইচ্ছা বাবা, বানায় রাখতাছি।"
আজ হঠাৎ করে তার মুখে বাবা ডাক টা শুনে খুবই ভালো লাগছে। মমতাময়ী কন্ঠে যেন নির্ভেজাল ভালোবাসা, অথচ ছোট কাল থেকেই তিনি এভাবেই আমায় সম্বোধন করে আসছেন। আজ হঠাৎ এ কথা মনে হলো কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার কছে নেই।
ভার্সিটিতে ভর্তির পর বছরে দু তিন বারই আসা হয় বাসায়। অনেক স্মৃতিই এখন ঝাপসা হতে শুরু করেছে। পরিবারের ছোট ছেলে। তাই ঘরমুখো থাকতে হয়েছিল ছোট থেকেই। আম্মু ও রাবেয়া খালার অতি আদরে বড় হয়েছি। বলতে গেলে রাবেয়া খালার কোলেই আমার শিশুকালটা কেটেছে।
আজ হঠাৎ করেই এসব ভাবনার কারণ খুঁজে পাচ্ছি নাহ। পুরনো স্মৃতিতে আলোড়ন ঘটলো।
"মমতার প্রতিদান" বলে একটা কলাম পড়েছিলাম বহুদিন আগে। এ মমতার প্রতিদান কোন কিছু দিয়ে পরিশোধ করা অসম্ভব। এই মানুষটির কোলে পিঠে আস্তে আস্তে বড় হওয়া, হামাগুড়ি দেওয়া, হাটা, দৌড়ানো শিখেছি, শিখেছি কথাবলতে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আজ মনে হচ্ছে সময়ের গতি অনেক বেশি। দেখতে দেখতেই কতোগুলো বছর কেটে গেলো।
মায়া-মমতা বা ভালোবাসা এসবে কোন যুক্তিতে নিয়ে আসা যায় নাহ। এটা মানুষে মানুষে হয় আবার প্রাণীদের ক্ষেত্রেও হয়। মমতা, ভালোবাসা এসব ভাবনা ঘুরছে মাথায়। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একজনের কথা মনে পরে গেল।এখন প্রায়ই মনে পরে তার কথা। ভুলতে চাই ভুলতে পারি নাহ কোন মতে।
শেষবার তাকে দেখেছিলাম ক্লাস ১০। চুল কাটিয়ে বাসায় যওয়ার পথে তার দেখা, ছয়টি বছর কেটে গেলেও আজও স্পষ্ট মনে আছে জুহাইরিয়া ওর বাবার সাথে এক মোবাইলের শোরুমে ঢুকলো কথা বলার সাহস ছিলনা সেদিন। কচু পাতা রঙের থ্রিপিস তাতে সুন্দর এমব্রয়ডারি করা, দারুণ মানিয়েছিল।
সেভেনের পর আর সেভাবে কথা হয়নি। এর মাঝে অনেকটা বছর কেটে গেছে। সময়ে গতিময়তায় অনেক কিছুরই পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখনও তাকে নিয়ে ঠিক আগের মতোই এ ভাবনার খেলা চলছে হয়তো আগের থেকে অনেকটা বেশি।কথা বলার সব মাধ্যমই আছে তবে কথা বলা হয়ে ওঠে না।
"এই দিলরাজ কই যাচ্ছিস??" এভাবেই ডেকতো রাস্তায় দেখা হলে। হঠাৎ কোন একদিন হয়তো দেখে ভিরের মঝে ডেকে বলবে "এই দিলরাজ কই যাচ্ছিস??" হয়তো…
হালকা বাতাস বইছে , হুট করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। এ জগতের ভালবাসা ও মমতা বিষয়গুলো ভারি অদ্ভুত। কোন লজিক নেই। এমনি এমনি-ই যেন হয়ে যায়। অনেকগুলো শরতের স্নিগ্ধ বিকেল জীবন থেকে চলে গেছে। মাঘের কনকনে ঠান্ডাও আজ আর অসহ্য মনে হয় না।
রাবেয়া খালার মারা যাওয়ার কয়েক বছর হলো, তাঁর ছেলে এসেছিল দেখা করতে। সে বলল- আম্মায় মারা যাওয়নের আগে কইছিল–"আমার দিলরাজ আইছে কি?? আমার দিলরাজরে ডাক দাও কেউ! শুনে অবাক হয়েছলাম। একজনের প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে এটা সম্ভব। মনে হলো নিজের মা কে হরিয়েছি সেদিন। জীবনের বিষয় দুটিতে চরিত্রগত পার্থক্য থাকলেও অনুভূতির মাপকাঠিতে তা সমান। সিক্ত এই ভালোবাসা নিয়েই জীবন কেটে যাচ্ছে। অনুভূতির বিষয়গুলো বেশ জটিল, কোন সমীকরণের মঝে এটিকে বুঝে ওঠা যায় নাহ।
ও আজ হেটে যাচ্ছে। পরনে সাদা এপ্রন, গলায় stethoscope ঝোলানো, পাশে আরেকজন।
ও হাসছে, হাত ধরে হেটে যাচ্ছে একে অপরের।
এসব দেখে খুবই ভালো লাগছে কেন জানি!!!
হয়তো এখনো ভালোবাসি তাই.......
লেখক: তানভীরুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এআই//এমজেড
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: