Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

নিষিদ্ধ জগৎ থেকে কলেজছাত্রীর অালোতে ফেরার গল্প

প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০১৮, ১৯:০৮

মেয়েটাকে (কলেজছাত্রী) এক রাতের জন্য ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলাম। বাড়িতে সপ্তাহ খানেক কেউ থাকবেনা। বাবা-মা জরুরি কাজে বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন। ছোটবোনটা মহিলা কলেজের হোষ্টেলেই থাকে। বাড়ি একদম ফাঁকা...

কেন এনেছিলাম জানেন? আমি একটা প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ক্রমশ ড্রাগ এ্যাডাক্টেড হয়ে পড়েছি। মেয়েটাকে ভালবাসতাম, কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে বিয়ে করে বরের সাথে লন্ডন চলে গেছে। কারো ধার ধারতাম না আমি -লেখাপড়া বন্ধ করে সারাদিন নেশায় পড়েছিলাম। তখন প্রায় পড়ালেখা শেষ,

বাবা মা কেঁদে কেঁদে বারবার এই পথ থেকে ফিরে আসার জন্য বলত। ছোটবোনটা প্রায়ই ফোন দিয়ে কাঁদে, বলে ভাইয়া ফিরে আয় তুই। কিন্তু আমার ফেরার কোন রাস্তাই ছিলনা, কষ্টে বাঁচার কোন ইচ্ছেই ছিলনা মনের মাঝে।

সে রাতে হেরোইন কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ অন্ধকার রাস্তার কোন এক পাশ থেকে অচেনা একটা মেয়ে এসে বলছিলো, ভাইয়া পছন্দ হয় আমায়? অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম তারপর বলেছিলাম, দূরে থাক আমার থেকে, আমি ওরকম না।

মেয়েটা আরো কাছে এসে বলে, প্লিজ ভাইয়া, দেখুন না তাকিয়ে আমার দিকে, কোন কমতি নেই আমার মাঝে। খেকিয়ে বলেছিলাম, তোকে বলছি না এখনি চলে যেতে মেয়েটা বোধহয় একটু ভয় পেয়েছিল। ভয়ে ভয়ে বলেছিলো, টাকার খুব দরকার ছিলো, যা দেবেন তাই দিয়েই, ভাবতে লাগলাম আমি। কাছে যা টাকাছিলো তা দিয়ে আরো ছয় দিন চলতে হবে। কোনভাবেই নষ্ট করা যাবেনা, কারণ নেশাখোরদের কেউ টাকা ধার দেয় না। বাড়িতে বাবা মা-ও নেই। ভাবছিলাম, মনে মনে কয়েক সেকেন্ড একটা হিসাব করছিলাম।

হঠাৎ আমার ভাবনায় ছেদ করে মেয়েটা আবার বলেছিলো, আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই যাব। বললাম, আমার বাড়িতে যাবি? মেয়েটা মাথা নাড়ে। বেশি কিন্তু দিবোনা,তুই রাজি তো? মেয়েটা আমার পিছনে আমায় অনুসরণ করে চলতে থাকে, কিভাবে কি করব কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না সেদিন।

ভাবলাম নেশাটা আগে সেরে নেই। বাড়িতে গিয়ে দরজা খুলে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে সবে মাত্র একটা টান দিয়ে ছিলাম। মেয়েটা বলেছিলো, ভাইয়া আমার সামনে এগুলো খাবেন না। আমার মাথা ঘোরে, বমি আসে। কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম সে রাতে। ভাবছিলাম মেয়েটার জীবনে কি আমিই প্রথম নেশাখোর? নাকি ওর বিছানায় শোয়া প্রত্যেকেই ভালো ছিলো?

সন্দেহের বশে বলেছিলাম, কেন হেরোইনের ধোয়ায় তোর বুঝি কষ্ট হয়? ও উত্তরে বলেছিলো, হুম, খুব খারাপ লাগে, বিড়ি, সিগারেটের ধোয়াও সহ্য হয়না আমার। ফেলে দিয়েছিলাম হেরোইন সে রাতে।

মেয়েটাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তুই কি এই লাইনে নতুন? মাথা নেড়েছিলো, ও. বললাম তবে কেন এসেছিস এই নোংরা জগতে? এই জগতটাতো ভালো নয়। ও মাথা তুলে আমার মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়েছিল। ওর চোখমুখে ছিলো বিস্ময়ের আবছায়া। হয়ত ও অবাক হয়েছিলো এইভেবে যে, এমন প্রশ্ন তো কেউ কোনদিন করেনা, এতগল্পের সময় তো কারোকাছে থাকেনা।

ও বিছানা থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে আমি বলেছিলাম, পুরো দুহাজার দিবো রাতটা থাকবি আমার সাথে? থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে বলে আগে টাকাটা দিন। টাকা বের করে দিলাম। তিন দিনের নেশার টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম ওর হাতে।
ও হেসে বলেছিলো, ভাইয়া একটু ফোন করতে পারি?
বললাম আমার ফোননেই। ও একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো, ফোন
নেই? আরে নিয়ে নেব না। আমি ওরকম মেয়ে নই।
আমি বললাম, জানি তুই ওরকম না। কিন্তু সত্যিই আমার ফোন নেইরে, ওটাকে বেঁচে সাতদিন আগে হেরোইন খেয়েছি। কিন্তু কেন বলত? ফোন কি করবি?অন্য কাউকে
বাতিল করবি নাকি?

মেয়েটা কিছুই বলেনি, কোন উত্তর করেনি। চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো,
রাত আনুমানিক বারোটা, মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। আমি কি করব বুঝতে পারছিলামনা। নেশা
টাও এতক্ষণে চড়ে বসেছে। সিগারেটের চিকচিকে কাগজটায় হিরোইন নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিলাম। হঠাৎ মেয়েটা কেশে উঠলো, বুঝতে পারলাম ধোয়ায় ওর কাশি উঠেছে।

হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠে, বলেছিনা আমার সামনে খাবেন না। যান বাইরে থেকে খেয়ে আসুন। আগুন নিভিয়ে বাহিরে যেতে চাইলাম। ও আবার বলে, কেন খান এগুলো?
বললাম কষ্টে। ও বলে, কিসের জন্য আপনার এত কষ্ট যে জীবনটাকে এভাবে আঁধারে নিয়ে যাচ্ছেন?

ওর প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম সেদিন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওর ভালো করে দেখছিলাম সেদিন। বয়স খুব একটা না, বছর সতের হবে হয়ত। বলেছিলাম, তোর জীবনটা কোথায়? কোন আলোয় আছিস তুই?

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পর চোখের কোনবেয়ে জল গড়িয়ে আসে। আমি
আরো অবাক হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর চোখের জল মুছে ও বলেছিলো, কিছু করবেন না?
আমি বলেছিলাম, কিছুই করার ফিলিংস নাই রে। তুই ঘুমা, ও আবার প্রশ্ন করে, কেন?
এমনিতেই। তুই বলেছিলি না কেন আমি নেশা করি? শুনবি?

মেয়েটা মাথা ঝোকায়। আমি বলি তাহলে শোন, আমার পেছনের ফেলে আসা ইতিহাস। যেখানে শুধুই হাহাকার আর কষ্ট। মেয়েটা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে ও যখন চলে যাচ্ছিল বলেছিলাম, তোর ঠিকানাটা দিবি? ও বলেছিলো না। বললাম আজ আবার এই ঠিকানায় চলে আসিস। মেয়েটা হেসে বলে আচ্ছা, আজ কত নেবে সে টাকার কথা না বলেই চলে গেল ও।

পরদিন ওর গল্প শুনতে লাগলাম, ও বলে, আমি কলেজে পড়ি। এবার বিএ. পড়তাম। যদিও বাবা বেঁচে নেই। ছোট্ট একটা বোন, মা আর আমি। এই আমার পরিবার, এই আমার দুনিয়া,। দিনের বারোটা পর্যন্ত মানুষের বাড়িতে কাজ করি আমি। বিকেলে বাচ্চাদের পড়াই। মাঝে মাঝে কলেজে যেতাম!

আর মা সারাদিন কাজ করতেন। রাতে বাতির আলোয় কলেজের বইপড়ি। বছর তিনেক আগে পাঁচ হাজার টাকায় ঝিয়ের কাজ করতাম এক বাড়িতে। তারা সকালে নাস্তা আর দুপুরের খাবার দিতো আমায়। দিব্যি চলে যেত দিন।

আমি বললাম, তারপর?
তারপর যখন এসএসসি পাশ করেছিলাম, কলেজে ভর্তি হলাম। লেখাপড়ার খরচ বাড়তে লাগলো। প্রাইভেট পড়ার সময় ছিলোনা, গাইডের প্রয়োজন দেখা দিত। প্রথম প্রথম বান্ধবীদের থেকে নিতাম। কিন্তু ঝিয়ের কাজের জন্য প্রতিদিন কলেজে যেতে পারতাম না। তাই তারাও আর নোট দিতনা। অবশেষে বাড়ির মালিককে বলে দুপুরের খাবারের বদলে একহাজার টাকা বেতন বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। সকালের নাস্তার দুটো বিস্কুট আর এক কাপ চা
খেয়েই কাজ করতাম সারাদিন।

এটুকু খেয়ে তুই থাকতে পারতি? তোর কষ্ট হতনা? প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিলো। পেটে
মোচড় দিয়ে ব্যাথা হত। মাথা ঘুরে পরেও গিয়েছিলাম কয়েকদিন।
জানেন, মালিকের বাড়িতে দুটো গরু ছিলো। বহুদিন গরুকে খাবার দিতে গিয়ে ঐ পঁচা পান্তাগুলো খেয়েছিলাম। কি করব, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারতাম না। আর কাজ না করলে মালিক তো বেতন দেবে না।

রাতের খাবার মা অন্যের বাড়ি থেকে আনত। ছোট বোনকে খাওয়ানোর পর যা থাকত, মা আর আমি ভাগ করে খেতাম। আমি মাকে বলতাম মা, জীবনে একদিন সুখ আসবেই। একদিন কষ্টগুলো সুখে রুপান্তরিত হবেই।
তারপর?
মেয়েটা আবার বলতে থাকে, আমি ইন্টার পাশ করলাম। কিন্তু আর কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। যে বস্তিতে থাকতাম কয়েকদিন আগে সেখানে আগুন লাগে। ঘরে যা টাকা ছিল সব আগুনে পুড়ে গেছে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। আবার কষ্টটাকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম। এবার বিকেলে বস্তির বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এবছর না হোক সামনের বছর আবার ভর্তি হব। কিন্তু হয়ত সে কপাল আমার নেই। একরাতে বাড়ি ফেরার পথে মা এক্সিডেন্ট করে বসেন।

কষ্টটা যেন এবার নিয়তি হয়ে গিয়েছিলো। কি করব আমি, কোনদিকে যাব? ভাবতে লাগলাম গরিবের দুঃখই যে নিয়ামত! একদিকে ছোটবোন, আরেকদিকে হাসপাতালে মা। কোন
পথ না পেয়ে দিনের কাজের পাশাপাশি রাতে এ পথে নেমে এলাম, আমি
তারপর কি হল রে,
মেয়েটার কন্ঠ ভারি হয়ে আসে, ও কাঁদোকাঁদো স্বরে বলতে থাকে,
ব্যবসা করতে লাগলাম নিজের দেহ দিয়ে, আজ একটা মাস যাবত মার কাছে ছোট বোনকে
রেখে রাতে পড়ার নামে বেড়িয়ে পড়ি আমি। ফেরি করে বেড়াই নিজের দেহ নিয়ে। দেহটার কত মূল্য হবে নিজেই ঠিক করে দেই, কাঁদতে থাকে মেয়েটি, কাঁদতে থাকি আমি।

মেয়েটা তারপর থেকে রোজ আসত। আমি বুঝতে পারি আমার হেরোইনের নেশাটা এখন বদলে গেছে। নেশাটা এখন ওর গল্প শোনায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমিও তখন নেশা বাদ দিয়ে তার সাথে সময় কাটাতাম হঠাৎ একদিন শুনলাম ওর মা মারা গেছে।
খুবই দুঃখ পেলাম, কি করব বুঝতে পারছিলাম না।

আমি বাবাকে বললাম তার জীবনের কাহিনী ও আমার খুঁজে পাওয়া, বলেছিলাম, বাবা আমার স্বপ্নতো জোড়া লেগে ভেঙেছিলো, কিন্ত আমি এ মেয়েটা স্বপ্নের খোঁজটুকুও পায়নি।
বাবা বিজ্ঞান বিষয় খুব ভালো বুঝতেন। দুটো কালো মেঘের ঘষায় সৃষ্ট বিদ্যুৎ যে সবাইকে আলোকিত করতে পারে, এই হিসাবেই আমি আর মেয়েটাকে একত্র করে দিলেন। বিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিলেন, দুজনের আঁধারের জীবনটাকে এবার আলোকিত করো তোমরা। আর আমি হয়ে গেলাম বিবাহিত ও হ্যাঁ, মেয়েটার নাম অতশী।

আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। আমি, অতশী, বাবা-মা-বোন, আমাদের ছোট শিশু আনজু আর ওর ছোটবোন রেখা, ওর মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করছি। অতশী কেঁদে কেঁদে বলল, মা বলেছিলাম না, সুখ একদিন আসবেই। আজ দেখ আমি কত সুখে আছি, কিন্তু তোমার অনুপস্তিতিতে, তারপর সবাই কবর জিয়ারত করে গাড়ি করে বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

[collected]
কার্টেসি : ইশতিয়াক আহমেদ ইমন
শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা, ১৭ জুন (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ