শান্তনা রহমান, চট্রগ্রাম: কেউ ছিলেন ছাত্র আবার কেউ ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খৈয়াছড়া পানির ঝরনা দেখে আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না। ঘাতক ট্রেন কেড়ে নিল ১১ জনের তাজা প্রাণ। আরো কয়জনকে করে দিয়েছে পঙ্গু। এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হলো না তাদের অধিকাংশের। হাটহাজারীর আর এণ্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিলো সকলেই। সবার কথা একটাই নিয়তির নির্মম পরিহাস। ১১ পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ১১জনের মৃত নিতর দেহ তাদের স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিস্ট সূত্রে জানাগেছে প্রায় দেড় ডজন মুখ একত্র হয়েছিল এক উদ্দেশ্যে। আড্ডা আর বেড়ানো হবে একসঙ্গে। সকলেই এক কোচিংয়ের সঙ্গী ছিলেন । কেউ পড়তেন, কেউবা পড়াতেন। নির্ধারিত দিনে শখের সে যাওয়া তাদের হলো, তবে অধিকাংশই ফিরলেন লাশ হয়ে। এক রেল-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় হাটহাজারীর টগবগে এই তরুণদের নাম জুড়ে গেল মিরসরাইয়ের নতুন ট্র্যাজেডিতে। সৃস্টি হলো নতুন এক করুন ইতিহাস।
মিরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় রেললাইনে ওঠার পর দুর্ঘটনায় হতাহতদের বহনকারী মাইক্রোবাসটিকে একটি ট্রেন ধাক্কা দেয়। এরপর মাইক্রোবাসটিকে ট্রেনটি।প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শিরা জানালেন। ঘটনাটি শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরের। এ ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়েছেন। হতাহত সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী বলে জানিয়েছেন। ১৭ জন ছিলো ওই ভ্রমনের সঙ্গী।
নিহতদের মধ্যে আটজনের নাম জানা গেছে। নিহত শিক্ষক চারজন হলেন- হাটহাজারী নগরীর লাইনম্যান কবিরের বাড়ির আবদুল হামিদের ছেলে জিয়াউল হক সজীব (২২), আজিজ মেম্বারের বাড়ির জানে আলমের ছেলে ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), আবু মুসা খান বাড়ির মোতাহের হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯) এবং মজিদ আব্বাস চৌধুরী বাড়ির বাদশা চৌধুরীর ছেলে শিক্ষক রিদুয়ান চৌধুরী (২২)।
শিক্ষার্থীরা হলেন- বজল কন্ট্রাক্টর বাড়ির মোজাফফর আহমদের ছেলে মোসহাব আহমেদ হিসাম (১৬), বাছা মিয়া সওদাগর বাড়ির মনসুর আলমের ছেলে মো. মাহিম (১৭), পারভেজের ছেলে সাগর (১৭), আবদুল ওয়াদুদ মাস্টারের বাড়ির আবদুল মাবুদের ছেলে ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), আবদুস শুক্কুর লাইনম্যান কবিরের বাড়ি আয়াতুল ইসলাম (১৭) এবং হাজী জালাল কোম্পানি বাড়ির মো. ইলিয়াছের ছেলে মোহাম্মদ হাসান (১৮)।
নিহত গাড়ি চালক হলেন, নগরীর আবদুর আজিম সাব রেজিস্ট্রার বাড়ির হাজী মোহাম্মদ ইউসুফের ছেলে গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬)।
শুক্রবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক খৈয়াছড়া পানির ঝরনা দেখতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তারা দুর্ঘটনার শিকার হন।
এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ছয়জন। তাদের উদ্ধার করে প্রথমে মীরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা করা হয়।
চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার নিবেদিতা ঘোষ বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ছয়জনকে চমেক হাসপাতালে আনা হলে তাদের হাসপাতালের ২৮ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়।
এরা হলেন- মাইক্রোবাসের হেলপার তৌকিদ ইবনে শাওন (২০)। তিনি আকবর শাহ থানাধীন শেরশাহ কলোনির মো. সোলাইমানের ছেলে। আহত বাকী পাঁচজন হলো- আমান বাজার এলাকার মৃত পারভেজের ছেলে তছমির পাবেল (১৬), মনসুর আলমের ছেলে মো. মাহিম (১৮), ছৈয়দুল আলমের ছেলে মো. সৈকত (১৮), আব্দুর রহিমের ছেলে তানভীর হাসান হৃদয় (১৮) ও আবুল কাসেমের ছেলে জুনায়েদ কায়সার ইমন (২২)। এর মধ্যে ইমন ছাড়া সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
এ ঘটনায় গুরুতর আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। চমেক পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত এসআই আলাউদ্দীন তালুকদার বলেন, ৫ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশংকাজনক। ২৪নং ওয়ার্ডে একজনকে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের আইসিইউতে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ট্রেনটি ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী জানান, ট্রেনটি বড়তাকিয়া ক্রস করার সময় লাইনে উঠে যায় মাইক্রোবাসটি। এসময় ইঞ্জিনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসটি কিছু দূর চলে যায়। আনসার আলী দাবি করেন, লেভেল ক্রসিংয়ের বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি লাইনে উঠে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
রেলক্রসিংয়ে ব্যারিকেড নামানো ছিল না:
আহত জুনাইদ কাউসার ইমন বলেন, ‘ওই রেলক্রসিংয়ে ব্যারিকেড নামানো ছিল না। তাই আমাদের মাইক্রোবাসের ড্রাইভার গাড়ি রেললাইনের উপর তুলে দেন।‘ মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসে থাকা আহত জুনাইদ কাউসার ইমন (১৭) এসব কথা বলেন।
শুক্রবার (২৯ জুলাই) রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। সেখানে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ দাবি করেন। আহত ইমন হাটহাজারী উপজেলার আমান বাজারের খন্দকিয়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি হাটহাজারীর কেসি শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র।
ইমন বলেন, দুপুরে ঝরনা থেকে ফিরে একটি দোকানে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা বাড়িতে ফেরার উদ্দেশে গাড়িতে উঠি। সবাই তখন অনেক ক্লান্ত ছিল। আমি সবার পিছনের সিটে বসেছিলাম। রেললাইনের কাছাকাছি আসতেই আমাদের গাড়ি সামান্য স্লো হয়ে যায়। তখন রেলক্রসিংয়ে আমরা কাউকে দেখতে পাইনি। কোনো বাঁশ বা ব্যারিকেডও ছিল না।
তিনি বলেন, রেললাইনে গাড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের গাড়িকে ট্রেন ধাক্কা দিয়ে কিছুদূর ঠেলে নিয়ে যায়। পরে আমি গাড়ি থেকে নেমে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকি। এরপর স্থানীয়রা এসে সবাইকে উদ্ধার করে। এদিকে ইমনের বাবা আবুল কাশেম বলেন, জুমার নামাজ পড়ে বাসায় আসার সাথে সাথে ট্রেনের এক যাত্রী আমাকে কল দিয়ে বলে আমার ছেলে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আমি যেন তাড়াতাড়ি মিরসরাই চলে আসি। আমি বাসায় কাউকে না বলেই বের হয়ে যাই। দশ মিনিট পর ইমন আমাকে কল দিয়ে বলে তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন একটু স্বস্তি পাই। সাথে সাথেই মেডিকেল চলে আসি। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া আমার ছেলে সুস্থ আছে।
চাচ্চু আমি পিকনিকে যাচ্ছি, দোয়া করো:
সকালে বন্ধুদের সঙ্গে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় ঘুরতে যাওয়ার সময় চাচাকে সর্বশেষ এই কথাটিই বলেছিলেন মিরসরাইয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত স্কুলছাত্র মুসাদ আহমেদ ইমাম (১৭)। ২৯ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ফ্লোরে বসে ভাতিজা মুসাদের সঙ্গে সর্বশেষ আলাপচারিতার কথা জানান তার চাচা আকবর হোসেন মানিক। নিহত মুসাদ হাটহাজারীর ৬নং চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের মৃত মোজাফফর আহমেদের ছেলে।
মেডিকেলের ফ্লোরে বসে আকবর হোসেন মানিক বিলাপ করতে করতে বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর মুসাদকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করেছি। ওর মা কানাডায় থাকেন। ওকে কখনও মা-বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে দিইনি। আমি এখন কী করব? কাকে রাতের বেলা মুসাদ বাবা বলে ভাত খেতে ডাকব। তার মাকে আমি কী জবাব দিব?
মুসাদের আরেক চাচা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, দুপুরে আমাদের কাছে কল আসে আমার ভাতিজা ও তার সহযাত্রীদের বহনকারী গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সবাইকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে এসে যারা আহত হয়েছে, তাদের মাঝে মুসাদকে খুঁজি। কিন্তু পাইনি। পরে জানতে পেরেছি সে মারা গেছে।
'কিছু না খেয়েই চলি গেলি বাপ’:
‘সোনা মানিককে কত করে বললাম, কিছু খেয়ে যা। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ার কথা বলে কিছু না খেয়ে বেরিয়ে গেল বাপধন। আমি এখন কাকে সোনা মানিক বলে ডাকবো। কাকে বলবো, সোনা মানিক আয়, খেয়ে নে। এই হতভাগীকে আর কে ‘মা’ বলে ডাকবে। আমি তো একা হয়ে গেলাম, বড় একা।’
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ২৯ জুলাই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে বসে বিলাপ করছিলেন মিরসরাইয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে নিহত মো. মারুফের (১৮) মা কামরুন নাহার।
খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে গিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এ দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন মো. মারুফ। তার বাবার নাম আব্দুল মাবুদ। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার যোগীরহাট এলাকায় নানির বাড়িতে থাকতেন। কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা ছিলেন তিনি।
নিহত মারুফের মা কামরুন নাহার বলেন, মারুফ আমার একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়েই আমার পৃথিবী। আমার আদরের টুকরা সন্তান ছাড়া আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো। তিনি বলেন, আমি গত রাতে তাকে মানাও করেছিলাম না যেতে। যদি জানতাম এরকম কিছু হবে, তাহলে কখনো আমার সোনা মানিককে যেতে দিতাম না।
মারুফের মামা মো. নাইম বলেন, মারুফের বাবার সাথে তার মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর সে তার মায়ের সাথে নানার বাড়িতে থাকত। মারুফই সব তার মায়ের। দুপুরে যখন দুর্ঘটনার খবর পাই, মিরসরাই যাওয়ার জন্য রওনা দিই। কিন্তু পরে শুনি সবাইকে চমেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাই এখানে ছুটে আসি। কিন্তু হাসপাতালে আনা আহতদের মধ্যে মারুফকে খুঁজে না পেয়ে বুঝেছি সে আর নেই। পরে ছবিতে মারুফের লাশ দেখে নিশ্চিত হই।
প্রসঙ্গত, মাইক্রোবাসযোগে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ভ্রমণে যান হাটহাজারীর আমান বাজারের আর এন জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীরা। ঝরনা থেকে ফিরে আসার সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সাথে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ৬ জন চমেক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
ঢাকা, ২৯ জুলাই (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: