Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

হাবিপ্রবির ছাত্র সজল যেভাবে না ফেরার দেশে

প্রকাশিত: ৭ মে ২০১৮, ০৪:৩৪

সাদ্দাম হোসাইন: আইসিইউ এর সামনে অপেক্ষা করছি। কিসের জন্য অপেক্ষা সেটা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা তিনজন শিক্ষক ভিতরে প্রবেশ করলেন। ডাঃ জামাল উদ্দীন মিন্টু ভিতরে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন। কি ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন তাও জানি না। আইসিইউ রেস্ট্রিকটেট এরিয়া! অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।

ভিতরে ঢুকলাম। ডাক্তার সাহেব কে রিকুয়েস্ট করলাম, স্যার আপনাকে একটু হলেও ব্রিফিং দিতে হবে। তিনি দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, কি বলবো? আমি আবার রিকুয়েস্ট করলাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন প্রফেসর এসেছেন! কিছু একটা শুনতে চান! তিনি রাজি হলেন।

ডাক্তারের চেম্বারে তিনজন স্যার সহ অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি আসলেন। তিনি জানালেন, একদল ডাক্তার মনে করেছেন, এক্সিডেন্ট ঘটার দশ পনের সেকেন্ড আগে সে স্ট্রোক করে। গাড়ি চালানো অবস্থায় স্ট্রোক করার পরও একশ থেকে দেড়শ গজ বাইকটা চালায় সে। তখন এক্সিডেন্ট ঘটে যায়।

কথাটা আমার অনেকাংশেই বিশ্বাস হল। এক্সিডেন্টের দিন সজলকে এরায় এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আমি আমার কয়েকজন কলিগসহ স্পটে যাই। ঘটনাস্থল হল রংপুর শহর আর পাগলাপীরের মাঝামাঝি। সেখানে আবুল খায়ের টোবাকোর একটি কোম্পানি আছে।

বাইকে সজল যাচ্ছে দিনাজপুর। একটি চার্জার অটো উল্টাদিকে আসছে রংপুরের অভিমুখে। রাস্তার একপাশে টোবাকো কোম্পানি অপর পাশে তিনটা চায়ের দোকান। সকাল সাড়ে সাতটা। কোম্পানিতে কাজ করার জন্য লোকজন এসেছে।

দোকানগুলি খোলা। তাদের ভাষ্যমতে, এক্সিডেন্ট তাদের চোখের সামনেই হয়েছে। অটো যাচ্ছিল তার সাইডে। সজল নিজের সাইডে। হুট করে যেটা ঘটলো সেটা ভয়ংকর। সজলের যে কি হল কে জানে, হুট করে বাইক টার্ন নিলো! সোজা ইজিবাইকের ভিতরে ঢুকে গেল বাইক টা।

প্রথমে বিশ্বাস করলাম না। ওরা ভয়ে মিথ্যা বলতে পারে। প্রায় দুইগজ সামনে গিয়ে দেখি, এক্সিডেন্টের কাচের টুবরা পড়ে আছে। একেবারে রাস্তার কিনারে। ওই দিকে বাইক নিয়ে যাওয়ার কোন কারন নেই।

ডাক্তারের কথা শুনে পুরোটাই পরিস্কার হল। খুব সম্ভবত এক্সিডেন্টের আগেই সে স্ট্রোক করেছিল। তারপর আবার অাঘাত। আবার ব্রেইনে রক্তক্ষরণ! মুল সমস্যাটা এখানেই। ডাক্তার বললেন, স্ক্যানিং-এ একটি স্পট পাওয়া গেছে। খুব সম্ভবত প্রিভিয়াস কোন একটি স্পট! এটির খবর হয়তো কেউ জানতো না।

ডাঃ মিন্টু স্যার মেডিসিন এ্যাপ্লাই করে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলেন এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে উঠার আগ পর্যন্ত। ঢাকায় অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ব্লাড প্রেসার অনেক কমে যায়। মস্তিষ্কের ডান দিকে হেমারেজ। ওখানে রক্ত সঞ্চালন নেই বললেই চলে। মেডিসিন এ্যাপলাই করে ব্লাড সার্কুলেশন সম্ভব হয় নি। অাবার, স্ট্রোক এর ফলে ভেইনের বাইরে আসা রক্তগুলি জমে যাচ্ছে। অপারেশন সম্ভব হল না।

ডাঃ মিন্টু স্যার সহজ ভাষায় বললেন, ক্রিকেট খেলায় যেমন দশটি উইকেট থাকে তেমি মানুষের জীবনে থাকে পনেরটি উইকেট। এর স্কেলিং হয় GCS সিস্টেমে। যদি এই স্কেলে পাঁচের নিচে রিডিং দেয় তবে সেই রোগির অপারেশন করা যায় না। জিসিএস সিস্টেমে সজলের রিডিং মাত্র তিন। তার মতে, ইতোমধ্যে বারোটি উইকেট হারিয়ে গেছে। যদি উপরওয়ালার ইচ্ছায় এই রিডিং পাঁচের উপরে হয় তবে তার অপারেশন করা যাবে।

তার হার্ট সচল। ফুসফুস সচল। পালস চলছে। ওয়ান এন্ড অনলি প্রবলেম, মস্তিষ্কে হেমারেজ। এখানে স্রষ্টার ইচ্ছায় রক্ত চলাচল হলেই কেবলমাত্র অপারেশন রিস্ক নেয়া যাবে।

ডাঃ মিন্টু স্যারের জীবনে এমন আরও একজন রোগি এসেছিল। একই গল্প। বাইক এক্সিডেন্ট! বত্রিশ দিন আইসিইউ তে ছিল। এর মধ্যে একদিন ডাক্তার বললেন, আর বাঁচানো সম্ভব না। মানুষ ভাবলেন রোগী মারা গেছে। তার জন্য কবর খোড়া হল। কেউ কেউ লাশ নিতে আসলো। কিন্তু স্যার দেখলেন, হার্ট সচল। এভাবে নাকি দুইবার কবর খোড়া হয়েছিল। জাস্ট মিরাকল!

বত্রিশ দিন পর জ্ঞান ফিরলো। সেই ছেলে এখন ব্যবসা করে। এখন সে বাইকে ঘুড়ে বেরায়। আশ্চর্য বিষয় হল, সাত বছর আগের জীবন ফিরে পাওয়া সেই ছেলেটি সজলকে দেখতে এসেছিল। ডাক্তার তাকে বললেন, সাত বছর আগে তোমার একই অবস্থা ছিল। তিনি বললেন, সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া মিরাকল এবার ঘটলেও অবাক হবো না।

একজন শিক্ষক বললেন, ডাক্তার সাহেব, আপনারা চেষ্টা করবেন। যা লাগে আমরা আছি। তিনি এবার আপ্লুত হলেন। জীবনের গল্প শুনিয়ে দিলেন। ডাক্তারি পড়ার গল্প। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় তার মা খুব অসুস্থ হয়। তিনি বারবার ডাক্তারের কাছে যান। গরীব ঘরে চিকিতসায় টাকা পাওয়া যায় না। সেদিন ডাক্তার আসেন নি। মা চলে গেলেন ওপারে। পিচ্চি মিন্টু কাদলেন। সেই পিচ্চি মিন্টু আজ ডাঃ জামাল উদ্দীন মিন্টু সাহেব হলেন। তিনি বললেন, শুধুই মায়ের আত্মার জন্য ডাক্তারি করি। টাকা নাম যশের জন্য না।

এই ডাক্তার আশ্বস্ত করলেন, বিন্দুমাত্র চেষ্টার ঘাটতি হবে না। আমরা আশাবাদী হতেই পারি। তিনি বললেন, তিনিও আশাবাদী। মিরাকল কিছু একটা হবে ইনশাআল্লাহ্। তিনি সকালেই আরও তিনজন নিউরোসার্জন কে ডেকেছিলেন। তারাও প্রফেসর। মেডিকেল সাইন্স যেখানে থমকে গেছে; সেখানে সবাই একটি মিরাকলের প্রত্যাশায় আছেন। যদি ব্লাড ব্রেইনে সার্কুলেট করা শুরু করে তবে.......... ইনশাআল্লাহ্।

অনেকে এসেছিলেন। অনেকে কাছ থেকে দেখতে পারেন নি। আইসিইউ সেন্সিটিভ জায়গা। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যায় না। প্রবেশ করলেও স্টেরিলাইজিং একটি ব্যাপার থাকে। তবুও অনেকে ভিতরে গিয়ে দেখেছেন। যাদেরকে দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারি নি, তাদের কাছে স্যরি।

স্যারের কাছ থেকে বেলা একটা থেকে একটা দশ মিনিট পর্যন্ত প্রবেশ করার একটি অনুমতি অনেক রিকুয়েস্ট করে নিয়েছিলাম। তারপরেও তাদেরকে বিরক্ত করে অনেককে দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়েছিল। পরে আর সম্ভব হয় নি। এভাবে ভীর করলে তাদেরও ট্রীটমেন্ট করতে ব্যাঘাত ঘটে।

রাতে ফিরে এসেছি মেডিকেল থেকে। বাসায় ফোন দিলাম। আমার মা এবং বড় বোন নামাজ পড়ে ওর জন্য দোয়া করেই যাচ্ছে। আব্বা বললেন একটা কাহিনী! হাতীবান্ধার একজন সার্জন নৌকা দিয়ে নদী পার হবার সময় নৌকাডুবি হয়। সার্জন মারা যান। কোলে থাকা পিচ্চি শিশু কমপক্ষে দুই আড়াইশ হাত দুরে গিয়ে ভেসে উঠে।

শিশুটি জীবিত। আল্লাহর কারিশমা বোঝা দায়। আব্বা বললেন, আল্লাহ্ কিছু একটা কারিশমা দেখাবেন মনে হয়। এমনও হতে পারে, ঢাকা থেকে ফেরত পাঠানো সজল রংপুরে সুস্থ হয়ে উঠেছে। আব্বার কথায় আশাবাদী হলাম।

আজ সজলের বাসায় খাসি কুরবানি হয়েছে। মাওলানা ডেকে দোয়া করা হয়েছে। আগামিকাল এসিআই কোম্পানি কুরআন শরীফ দান করবেন মসজিদে মসজিদে। খাসি কুরবানি করে গরীব লোকদের দিবেন।

চারদিকে এতো এতো দোয়া; এতো আহাজারি! আল্লাহ সদয় হোক। ব্রেইনে ব্লাড সার্কুলেট করুক। ডাঃ মিন্টুর জীবনে ঘটা সাত বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক; একটা মিরাকল হয়ে যাক; ফিরে আসুক সজল....


ঢাকা, ০৬ মে (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ