Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

গৌরবের সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করলো রাজশাহী কলেজ

প্রকাশিত: ২ এপ্রিল ২০২২, ০৫:৪২

হাসনাত হাকিম, রাজশাহী: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর মধ্যে টানা চৌতুর্থবারের মতো র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে রাজশাহী কলেজ। কলেজটি উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া কলেজটি আজ গৌরবের ১৫০ বছরে পদার্পণ করলো।

মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা কলেজটি ব্রিটিশ আমল থেকেই দখল করে রেখেছে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের আসন। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখনও স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহী কলেজ।

কলেজটি ইসলামী সুফিবীদ শাহ মখদুম রূপোশ (র.) এর মাজারের উত্তর পাশে প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত। এটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজটি পরিণত হয়েছে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো।

বর্তমানে প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর দেশের শিক্ষাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলা প্রতিষ্ঠানটি। আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ জমিদার রাজার হাতে জন্ম হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। এরপর অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এসেছেন জ্ঞানার্জনে, নিজেকে গড়েছেন, আবার কালের পরিক্রমায় আলো বিলিয়ে চলে গেছেন পরপারে। সেই আলোতে আজও পথ চলে নতুন প্রজন্ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৮টি সূচকে টানা চারবার এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি সূচকে প্রতিবারই সেরার মুকুট অর্জন করে রাজশাহী কলেজ। মডেল কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে এই কলেজের ঝুঁলিতেই।

জানা যায়, প্রাচীন বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল ও রাজশাহী জেলা স্কুলের (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) হাত ধরেই পথচলা শুরু করে রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালে দুবলহাটীর রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত হয় ভবন। ১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী জেলা স্কুলে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণি চালুর মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় প্রথম গ্রেডের মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় সে সময়েই। একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে রাজশাহী কলেজেই চালু হয় বিএ কোর্স।

বর্ণীল সাঁজে সেজেছে রাজশাহী কলেজ

 

১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স চালু হয় কলেজটিতে। স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি মিলে ১৮৭৭ সালের অক্টোবরে। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয় কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন)। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।

১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রমও। তবে শিক্ষার্থী নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম।

ভবনটির নির্মাণ শেষে বাউলিয়া হাইস্কুল থেকে রাজশাহী কলেজের ক্লাসসমূহ এই নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অনেকে ধারণা করেন, এই নতুন ভবনে ক্লাস শুরু হলে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ক্লাসসমূহ চালুর বিষয় অনুমোদিত হয়। প্রশাসন ভবনের সামনেই লোকজ বাংলার দেখা মেলে ‘রাজশাহীর চোখ’ টেরাকোটায়। আরেক টেরাকোটা ‘রক্তে ভেজা বর্ণমালা’ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার। এ ভবনের পেছনে গাঁদা, ডালিয়া, জিনিয়া, ক্যালেন্ডুলার সৌরভে ভরে ওঠে ক্যাম্পাস।

এ কলেজে পড়াশোনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি স্যার যদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ ও অন্যতম সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, জাতীয় চার নেতার অন্যতম এএইচএম কামরুজ্জামানের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা। তৎকালীন রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন।

কথিত আছে, অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওড়িশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন। চিনা কারিগর মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশশৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এই কলেজের প্রশাসন ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে সগৌরবে। কলেজের এই সুরম্য স্থাপত্যশৈলী এখনো সগৌরবে কলেজটির ঐতিহাসিক পরিচয় ঘোষণা করে, যা যেকোনো পথচারীর মনোযোগ কাড়ে নিরবে।

রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাস

 

হাজি মুহাম্মদ মহসীন ভবন, ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবনের মত লালরঙ্গের ভবনগুলো এখনও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে আছে। যে ভবনগুলো আজও সেই আমলের রাজকীয় স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয় বর্তমান প্রজন্মকে। এছাড়া বেশ কয়েকটি নতুন ভবনও রয়েছে। সেগুলোতেও করা হয়েছে প্রাচীন ভবনগুলোর মত লাল রং। ফলে রাজশাহী কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে লালরঙ্গের ভবন।

রাজশাহী কলেজ মানেই পরিপাটি ক্যাম্পাস। পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, আড্ডা, গল্প কিংবা গান সব কিছুই চলে সমান তালে। শুধু জ্ঞানার্জনই নয়, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলন বাঙালির সকল গৌরবোজ্জল ইতিহাসে আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে রয়েছে রাজশাহী কলেজের নাম।

এই কলেজেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী সব শহীদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণের খবর ট্রেনে করে রাজশাহী আসে। তাৎক্ষনিক রাজশাহী কলেজ ও আশপাশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার শিক্ষার্থীরা সমবেত হয় কলেজ ছাত্রাবাসে।সিদ্ধান্ত হয় ইট-মাটি দিয়ে রাতেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির। সে অনুয়ায়ী তৈরি হলেও পরদিন সকালে সেসব গুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি জান্তা বাহিনী।

সময়ের সাথে নিজেকে আধুনিকতায় সাজিয়েছে কলেজটি। কলেজের প্রতিটি বিভাগে চালু করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষকদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ। গবেষণা আর তথ্য বিনিময়ে বহির্বিশ্বের সাথে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগে দেয়া হয়েছে ওয়াই-ফাই সেবা। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রেণিকক্ষ, প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ ফটকগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে সিসি ক্যামেরায়। প্রায় তিন লাখ বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে রয়েছে এক বিশাল গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে পুরোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়াও নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় বইসমূহ। মুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনই সেখানে ভিড় জমান শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে পঞ্চাশোর্ধ সহশিক্ষা সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ), রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, বিতর্ক ক্লাব, রেঞ্জার গাইড, বিজ্ঞান ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, সংগীত একাডেমি, নৃত্যচর্চা কেন্দ্র, বাঁধন, বরেন্দ্র থিয়েটার, অন্বেষণ, নাট্য সংসদ, আবৃত্তি পরিষদ, ফটোগ্রাফি ক্লাব, রোটার‍্যাক্ট ক্লাব, এথিক্স ক্লাব, প্রেজেন্টেশান ক্লাব, ক্রিয়েটিভ ক্লাব, ইনোভেশন ক্লাব, রেড ক্রিসেন্টসহ প্রতিটি বিভাগে রয়েছে একটি করে স্বতন্ত্র ক্লাব। নামাজের জন্য রয়েছে দ্বিতল মসজিদ। নগরীর বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। এই কলেজের ঝুঁলিতে রয়েছে পাঁচশ’র বেশি কম্পিউটার সংবলিত ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব’। ল্যাবে কলেজের সকল শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ছাড়াও আউটসোর্সিং ও বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগেও রয়েছে আলাদা আলাদা ল্যাব।

রাজশাহী কলেজ

 

প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী জাকিয়া ইয়াসমিন জুঁই ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে গৌরবের ১৫০ বছর উদযাপন করতে পারাটা নিঃসন্দেহে অনেক আনন্দের। রাজশাহী কলেজ একটি আবেগের নাম। একটা ভালোবাসার নাম। একটা অনুভূতির নাম। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে নিজেকে উপস্থাপনের অসংখ্য সুযোগ পেয়েছি বলে জানান তিনি।

রাজশাহী কলেজ প্রিন্সিপাল প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, ১৮৭৩ সালে কলেজিয়েটের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হওয়া কলেজটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় উপমহাদেশের অসংখ্য জ্ঞানীগুণী জ্ঞানার্জন করে পুরো বিশ্বে সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। সরকারের সুনজর, অভিভাবকদের মানসিকতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরলস পরিশ্রম, রাজনৈতিক ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে কলেজটি। দক্ষ ও মেধাবী জাতি গঠনে সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলা গড়তে রাজশাহী কলেজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যক্ষ।

ঢাকা, ০১ এপ্রিল (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ