Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

বিশ্ববিদ্যালয় লাইফে শেষ ক্লাস, অামার যাওয়ার সময় হয়েছে

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বার ২০১৬, ১৮:৫৬


শামসুজ্জোহা বিপ্লব : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মাস্টার্সের শেষ ক্লাস করলাম। অনার্সতো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মাস্টার্সের ক্লাসটাও শেষ হয়ে গেল। শ্রদ্ধেয় শামীম আক্তার ম্যাডামের কোয়ান্টাম মেকানিক্স এন্ড পলিমার ক্লাস করার মধ্যে দিয়ে শেষ হল ক্লাস। ভাবতেই বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি। ক্লাস শেষ! আমার যাবার সময় হয়েছে।

আহা! আর ইচ্ছে করলেও কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার ম্যাডামদের কোনো ক্লাস করতে পারবো না। পারবো না বন্ধুদের সাথে ক্লাসে বসে দুষ্টামি আর ব্যাকবেঞ্চার স্টুডেন্ট হিসেবে ক্লাসের শেষ সিটটা দখল করতে। লেকচার শোনার বদলে মোবাইলে গেম খেলা, চুরি করে ফিসফাস করে কথা বলা। কোনোটাই আর হয়ে উঠবে না।

আজ থেকে আর কোনো ঝামেলা নেই, সকালে ঘুম থেকে উঠার যন্ত্রণা নেই, ক্লাস নেই, ল্যাবের ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা নেই, ক্লাসে দেরী করে ঢুকলে ম্যাডামের ঝাঁড়ি নেই, নেই স্যারের এ্যাসাইনমেন্ট আর সিআর এর ফেসবুকে গ্রুপে কোনো স্যার ম্যাডামের ক্লাসের পোস্ট।

আজ থেকে কাওসার স্যার আর হাসিমুখে কখনো বলবেন না। ব্যাকবেঞ্চের ঐ ছেলেটাকে দ্যাখো আজকে এসেছে, পিছনে লুকিয়ে আছে। স্যার আর হাসি দিয়ে বলবেন না, আজকে কতদিন পর ক্লাসে আসছো। আমার ক্লাস কয়টা করেছো তুমি। শুধু জ্বি স্যার বলতাম। স্যারতো জানতেন না। আমি সবসময় পিছনেই বসতাম।

শামীম আক্তার ম্যাডাম আর কোনদিন বলবেন না। দ্যাখো! দ্যাখো! ছেলেটা মনেহয় কেবল ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চুলের অবস্থা দ্যাখো! কি করো সারারাত তোমরা, রাতে ঘুমাও না নাকি? ম্যাডাম আর মনেমনে বলবে না আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যা হয়েছে। সারারাত যে কি করে আমি ভেবেই পাই না? কথাশুনে আমি নিশ্চুপ হয়ে যেতাম।

শামসুদ্দিন স্যার আর কখনো হাসতে হাসতে বকা দিয়ে বলবেন না। কিরে তোর চুল এত লম্বা ক্যান? চুল কাটার টাকা নাই নাকি? আজকেই রুমে যাইয়াই চুল কাটবি। না হইলে কিন্তু তোর চুল কাইট্টা দিমু। আমার কাছে কেঁচি আছে কিন্তু। আমিও আর মাথা নীচু করে বলবো না। জ্বি স্যার! আজকেই কাইট্টা ফালামু।

আমার কথাশুনে স্যার মনেহয় সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন এই পোলা তো চুল কাটবো না। লক্ষন ভালো না। খালি কথায় কথায় জ্বি স্যার! বলে ক্যান। তাই মনেহয় বলেছিলো, নেক্সট ক্লাসে তুই উপিস্থিত থাকবি। আমিও আর মুচকি হাসি দিয়ে বলবো না। জ্বি! স্যার!

শাহানারা ম্যাডাম আর কোনদিন বলবেন না। এই ছেলে তুমি আমার ক্লাসে টি-শার্ট পড়ে আসছো কেনো? ভার্সিটির ছেলেরা থাকবে ফিটফাট। তুমি আমার ক্লাসে কখনো আর টি-শার্ট পড়ে আসবে না। বুঝেছো। আমিও আর মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে বলবো না, জ্বি ম্যাম! আর আসবো না।

মতিন স্যার আর অর্গানিক কেমেস্ট্রি পড়াতে গিয়ে আমাদের নিয়ে মজা করে বলবেন না। অর্গানিক কেমেস্ট্রি বুঝতে পারলে খুব সোজা।  ঐ যে ঐ ছেলেটা বা মেয়েটা বাল্কি গ্রুপ। একটু মোটাসোটা ভারী আর কি? বুঝতে পারছো তোমরা। আমরাও আর সমস্বরে বলে উঠবো না। জ্বি স্যার!

জয়নাল আবেদীন স্যার আর ক্লাস নেওয়ার সময় বলে উঠবে না। ঐ যে পিছনের ছেলেটা তোমার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারো নাই, বুঝছি এখানেই গন্ডগোল। সমাধান আমাদেরই করতে হবে। আসো তাহলে আরেকবার ইকুয়েশনটা সলভ করার চেষ্টা করি। এবার ভাল করে বুঝবে কিন্তু। আমরাও আর বলবো না। জ্বি স্যার!

আজ ক্লাস শেষ করে বাইরে আসার পর বিজ্ঞান অনুষদের দিকে ছলছল চোখে আরেকবার ফিরে তাকালাম। এই সেই বিজ্ঞান অনুষদ। এই বিজ্ঞান অনুষদের দোতলাযতেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আর এখানেই টিকে যাই। এখানেই রসায়ন বিভাগে সাতটা বছর পার করে দিলাম। বেশিদিনতো নয়। এগুলোতো সেদিনের কথা।

কলার ঝুপড়িতে গিয়ে শেষবারের মতো আলী ভাইয়ের দোকানে বসলাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানেই বন্ধুদের সাথে চা আর কার্ড খেলার ঝড় উঠছে, টেবিল চাপড়িয়ে  বেসুরে গলায় গান ধরেছি অজস্রবার। পরীক্ষা শেষ করে সিগারেটর ধোঁয়ায় ধোঁয়াময় হয়েছে আলী ভাইয়ের দোকান। সে হিসেব হয়তো কেউ রাখে নি।

আলীর দোকানে আজ আমাদের বন্ধুদের প্রাণের সেই উচ্ছলতা আর নেই। সবাই কেমন শান্ত হয়ে গেছে। দোকানের টেবিল, চায়ের কাপ, নীল জগ আজো পরিপূর্ণ, খালি নেই। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে নতুন কোন এক বন্ধু গ্রুপের আড্ডায়, নতুনের আগমনে, টেবিল চাপড়িয়ে গান ধরেছে নতুন কোন ছেলেমেয়ে। সবকিছুই ঠিক আছে এখানে, শুধু আমরা নেই। আমি নেই।

রুমে আসার পর বারবার কেন জানি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষে কাটানো সময়গুলোর খুব মনে পড়ছে। এইতো সেদিন ২০১০ সালের জানুয়ারির দিকে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করলাম বিজ্ঞান অনুষদের গ্যালারি -১ এ। নতুন গ্যালারি, নতুন ক্লাস, নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পরিচয় আর হইহুল্লোড়।

ডায়েরিটা খুলে দেখলাম প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাসটা নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় তাপসী ম্যাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস এতো বেশি আবেগ আর উচ্ছ্বলতা ছিল ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আজো ঠিক মনে আছে উনি পড়িয়েছিলেন ইনঅর্গানিক কেমেস্ট্রির কোয়ালিটিটিভ এ্যানালাইসিস।

আর কয়েকদিন পরেই ডিপার্টমেন্টের হ্যান্ডসাম এক শিক্ষক ক্লাস নিলেন। প্রথম দিন ক্লাস নেওয়ার বদলে হাসিমুখে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন। সেই কথাগুলো আজো মনে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবদিক তোমাদের জন্য উন্মুক্ত। তোমরা যাই করো দিনশেষে পড়াশোনাটা ঠিক রাখবে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কারো জীবন কাটবে হাসি, আনন্দ আর পড়াশোনায়। তাদের কাছে এই পাঁচ-ছয় বছর খুব কম সময় মনেহবে। কখনো বোর হবে না তারা। আর কারো কারো কাছে এই সময়গুলো খুব কঠিন হবে, অনেকে হতাশায় ভুগবে। সময় তাদের কাছে কাটতে চাইবে না।

তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সবসময়, থেমে গেলে চলবে না। পরে জানতে পেরছি তার নাম মনির উদ্দিন স্যার। শেষবেলায় তিনি আজ আমার রসায়ন বিভাগের শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান। সত্যিকথা বলতে এই বয়সে এসেও তিনি এখনো আগের মতো হ্যান্ডসামই রয়ে গেছেন। বয়স তার মনটাকে বুড়ো করতে পারে নি।

প্রথম বর্ষের দিকে ক্লাস করার আগ্রহ শুধু বেশি নয়, খুব বেশি ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ কচলাতে কচলাতে ক্লাসে চলে যেতাম। ক্লাস করার মাঝেই যেনো সব আনন্দ খুঁজে পেতাম। আর ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে সুযোগ পেলেই কলা অথবা মেরিন সায়েন্সের ঝুপড়িতে বন্ধুদের সাথে চা, সিগারেট আর জম্পেশ আড্ডা।

দিনেদিনে যত সিনিয়র হতে থাকি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষে উঠি। ক্লাস করার গতানুগতিক হার আমার ততই কমতে থাকে। কি জানি কি নানা ব্যস্ততা। নিজের কিছুকিছু অলসতাও আছে বলা যায়। তবে আজ বুঝতে পারছি হাড়েহাড়ে, ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় কতটা খারাপ লাগছে? মনেহচ্ছে কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।

আমি ভাবতে পারছি না। শামীম আক্তার ম্যাম কত না সহজ ভাবেই বললেন? আজ থেকে তোমাদের মাস্টার্সের ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। কথাটা শুনেই বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ভাবলাম ভুল কিছু শুনলাম কি না? কিন্তু না ম্যাডাম আবার বললেন ফরমালি তোমাদের মাস্টার্সের ক্লাস আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা ক্যারিয়ারে যেনো সবাই ভাল করতে পারো এই প্রত্যাশা করছি।

আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাস শেষ হওয়ায়, আমার তো অনেক ভাললাগার কথা ছিলো।  খুশিতে আর একটু অলসতা করে ঘুমানোর কথা ছিলো কিন্তু বুঝতে পারছি না। আজ এতো মন খারাপ লাগছে কেনো। বারবার মনে হচ্ছে আর কয়েকটা দিন কষ্ট করে বেশি ক্লাস করলে তাতে কি এমন ক্ষতি হতো? অলসতাটা আর একটু কম করলে কতই না ভাল হতো।

কিছুক্ষন মাথা নীচু করে গভীরভাবে ভেবে দেখলাম। আজ আর পিছন ফিরে তাকিয়ে লাভ নেই। সময় চলে গেছে আমার ডেট এক্সপায়ার। যদিও মনটা বারবার প্রথম বর্ষের সেই উচ্ছ্বল দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাচ্ছে। সেই ক্লাস, সেই বন্ধু, সেই আড্ডা, সেই চায়ের কাঁপের দিনগুলোতে।

কিন্তু আফসোস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সোনালী জীবন কোনকিছুর বিনিময়ে আর কখনো ফিরে পাবো না। শুধু এই বেলাঅবেলার স্মৃতিগুলোই হাতড়ে বেড়াতে হবে। এ কথা জানি সারাজীবন এই স্মৃতিগুলো বসেবসে জাবর কাটলেও কখনো শেষ হবে না, এ যে শেষ হবার নয়।।


শামসুজ্জোহা বিপ্লব
রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা, ২৫ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//জেএন


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ