Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাপ অথবা ভালোবাসার গল্প

প্রকাশিত: ১৭ ডিসেম্বার ২০১৭, ১৯:৪৬

ফারহানা নিশি : ঘুম ভাঙার পর থেকেই শরীরটা কেমন যেন লাগছে আজ। অনেকদিন থেকেই শরীরটা খারাপ বুঝতে পারছি। কিন্তু করার কিছুই নেই। একটা পাপ করেছি জীবনে। তার পর থেকেই সেই পাপের চিহ্ন নিয়ে বাবা-মায়ের ঘাড়ে চেপে আছি। এখন তাই প্রয়োজনবোধেও মুখ খুলে অনেক কিছু চাইতে পারি না। ডাক্তার দেখানোর জন্যেও বলতে পারছি না তাই। এমনিতেও আমার জন্যে তাদের কম ভোগান্তি পেতে হচ্ছে না। সমাজের যারা আগে বাবাকে উঠতে বসতে সালাম দিতো, যারা অকৃত্রিম সমীহ করতো, তারাও আজ বাবাকে দেখলে না দেখার ভান করে চলে যায়।

পাশের বাড়ির আন্টিরা মাকে তাদের সাথে আর চায়ের আড্ডায় ডাকে না। ক্লাস টেনে পড়ুয়া আমার ছোট ভাইটা রোজ বিকেলে এখন আর ক্রিকেট খেলতে মাঠে যায় না। আমার বিষয়টা নিয়ে পাড়ার ছেলেরা নাকি খুব হাসাহাসি করে। ওর রাগ হয়। কী একটা কথা বলায় রেগে গিয়ে সেদিন নাকি ঘুষি দিয়ে এক ছেলের নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। কথাটা শুনে ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়নি। ওর সেই এক কথা, "আমার আপুকে নোংরা কথা বলার ও কে!" ভাইটা আমার এখনও বড্ড অবুঝ!

মাথার ভেতর অসহ্য যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। গা গুলিয়ে বমি আসতে চাচ্ছে। বাচ্চাটা পেটে আসার ছয় মাস থেকেই শরীর খারাপের মাত্রাটা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। চোখের নিচে কালসিটে পড়ে গিয়েছে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই নিজে চিনতে পারি না আজকাল। অথচ আগে মাঝে মাঝেই নিজে মুগ্ধ চোখে দেখতাম আমি।

ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ফেসবুকে এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয় আমার। যাকে কীনা বলে গভীর বন্ধুত্ব! দিন নেই, রাত নেই, আমাদের বার্তা আদান-প্রদান চলতেই থাকতো। গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে শুরু করে অহেতুক অনেক কথাও আমাদের বার্তা বিনিময়ের অংশ হয়ে উঠতো। পরিচয়ের পাঁচ মাসের ভেতরই ভালোবাসা কিনা জানি না, তবে এক তীব্র টান অনুভব করতাম ওর প্রতি। বিশ্বাসটা দিনে দিনে গাঢ় হওয়ায় একসময় নির্ভরতা চাইতে লাগলাম মনে মনে। মুখে প্রকাশ না করলেও, সরল মেয়েরা অনেক কিছুই তাদের আচরণে প্রকাশ করে দেয়। আমিও যেহেতু সেই দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, ছেলেটি আমার দুর্বলতা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। তাই ধীরে ধীরে সেও আমার প্রতি তার অনুভূতির বিষয়গুলো তুলে ধরতে লাগলো নানা উপায়ে। আমার চেয়ে বছর দুয়েক বড় ছেলেটির নাম ছিলো মুগ্ধ। ছিলো বলার কারণটা হচ্ছে, এই জগতে তার স্থান থাকলেও, বর্তমানে আমার মনোজগতে তার কোনো স্থান নেই। একেবারেই যে নেই, সেটাও বলা ঠিক নয়। আসলে তার সাথে কাটানো প্রতিমুহুর্তের স্মৃতি সম্পর্কটা ভাঙনের পর থেকে একেকটা বাজে স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। তার প্রতি ইতিবাচক অনুভূতিগুলো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে চিরতরে। মানুষ বাজে স্মৃতি মনে রাখতে চায় না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।

পরিচয়ের এগারো মাস পর সে আমায় প্রেমের প্রস্তাব দেয়। প্রথানুগামিতা রক্ষার্থে খানিকটা ইনিয়ে বিনিয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করি। দু'মাস যেতে না যেতেই আমাদের ভেতর শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যে খুব স্বেচ্ছায় মুগ্ধের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম, তা নয়। প্রথম প্রথমতো নানা অজুহাত দেখিয়ে, অনুরোধ করে ছাড় পেতে চাইতাম। তবে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গতি খুঁজে পেতাম না তার কৌশলী কথায়। ভালোবাসার দোহাই, ভরসার দোহাই আর কত কীইনা সে প্রয়োগ করতো আমায় বাধ্য করতে! আমি শেষ পর্যন্ত মেনেই নিয়েছিলাম। আসলে মেয়েরা যাকে আশ্রয় হিসেবে মনে করে, তার ভেতর কোনো পাপ খোঁজে না। আর খুঁজে পেলেও তা সহজে মানতে চায় না। মুগ্ধকে আমি সেই আশ্রয় হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম।

সম্পর্কের চার বছর গড়ায়। এইচএসসিতে বেশ ভালো ফলাফল করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তখন। মুগ্ধও ততদিনে পার্ট টাইম চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনাটাও বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে নিচ্ছে। চার বছরের ভালো মুহূর্তগুলো পুঁজি করে আমি তখন স্বপ্ন জাল বুনছি। আর তার অংশীদার হিসেবে মুগ্ধের ভূমিকাও নেহাৎ কম নয়। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, যেমনটা আমরা চাচ্ছিলাম। আসলে যেমনটা মুগ্ধ চাচ্ছিলো। ওর চাওয়াগুলোকেতো আমার চাওয়া হিসেবেই মেনে নিতাম। কিন্তু যখন আমি বুঝতে পারলাম আমার শরীরে এক নতুন আত্মার বাস, মুগ্ধকে কথাটা জানাতেই সে বদলে গেলো। বদলে গেলো আমার অপরিচিত মুগ্ধের রূপ।

বিয়ের কথা বলতেই অসম্মতি জানালো। গর্ভপাত করাতে বললো আমায়। আমি রাজি হইনি। হবার কথাও নয়। কারণ এই নতুন প্রাণ আমার কাছে মুগ্ধের ভাষায় "উটকো ঝামেলা" ছিলো না। ভালোবাসার অংশ মনে হতো। একদম অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো আমার। আমার নিজের সন্তান, ছোট্ট একটা প্রাণ, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন! কিন্তু এই বিষয়গুলোর কোনোটাই মুগ্ধের হৃদয় স্পর্শ করেনি। তাকে বরাবরই বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। অবশেষে একদিন যখন আমি তার পায়ে ধরে অনুরোধ করি, সে সজ্ঞানে আমার পেটে লাথি মারে। তীব্র ব্যথায় আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম তখন। নিজের জন্যে নয়, আমার ভেতর বাস করা ছোট্ট প্রাণটার জন্যে। তখন একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যাপার আমার বোধগম্য হয়েছিলো।

মুগ্ধ আমায় ভালোবেসে স্পর্শ করেনি কখনও। তার প্রতিটা স্পর্শেই ছিলো কামবাসনা। নাহলে সে আমাদের সন্তানকে কখনোই মেরে ফেলতে চাইতো না। সে আসলে আমাদের সম্পর্কটাকেই সম্মান করেনি। যদি করতো, তবে এভাবে আমাদের ভালোবাসার ফসল উপড়ে ফেলতে চাইতো না। মুগ্ধ আসলে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। যদি বাসতো, তবে আমায় ওভাবে ব্যথায় চিৎকার করতে দেখেও চুপ করে বসে থাকতে পারতো না। রাগ সামলে ঠিকই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো। কিন্তু সে তা না করে উঠে চলে গিয়েছিল। আমি কোনোরকমে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাক্তার আঁতকে উঠেছিলো সেদিন। জানতে চেয়েছিলো ওই অবস্থায় আমি একা যাবার কারণ, বাচ্চার বাবা না আসার কারণ। আমি জবাবে বলেছিলাম, "পাপের ফল জারজ হয়। ওদের বাবা থাকে না।" ডাক্তার চমকে তাকিয়েছিলো আমার দিকে। আমি চোখে পানি নিয়েও তার দিকে তাকিয়ে হেসেছি তখন। তিনি কী বুঝেছিলেন কে জানে। চেকআপ করে শুধু বলেছিলেন, "আল্লাহর কৃপায় বেঁচে গিয়েছেন। তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে।" এরপর আমি খুব সাবধানেই বাড়ি ফিরেছি।

মাকে সব বলেছি। মা পাগলের মতো চিৎকার করে কেঁদেছে শুধু। বাবা সব শুনেও আমায় কিছু বলেনি (এর কারণটা আজও আমার কাছে অজ্ঞাত!)। আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে মুগ্ধের বাসায় গিয়েছিল একদিন। মুগ্ধের পরিবার এ সম্পর্ক মানেনি, মুগ্ধও আমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। আমার মতো বাবাও সেদিন বুঝেছিল, জোর করে এ সম্পর্ক টিকাতে গেলে তা মোটেই আমার ভবিষ্যতের জন্যে সুখকর হবে না। সম্মানের ভয়ে মামলাও করেনি। আর অতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ায় মেয়ের জীবন ঝুঁকির কথা ভেবে গর্ভপাত করানোর কথাও বলেনি। ব্যস, মুগ্ধ আর আমার সম্পর্কের ইতি ওখানেই। কিন্তু, আসলেই কী তাই? মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন মনে আসলেই সন্দিহান হয়ে উঠি। শরীরে যার অংশ বয়ে বেড়াচ্ছি, তার সাথে কী এত সহজেই সম্পর্কের পাঠ চুকে যায়?

মাঝেমাঝেই যখন আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় কিংবা নিজের প্রতি ঘৃণা হতে থাকে, আমি আমার পেটে হাত রাখি। অদ্ভুত হলেও সত্যি, কার যেন সাড়া পাই তখন। ভেতর থেকে আধো আধো বুলিতে কে যেন বলে ওঠে, "আমি তোমার পাপ নই। আমায় ভালোবাসো, মা।" আনমনেই হেসে উঠি। বেঁচে থাকার এক নতুন উদ্দীপনায় বুক ভরে শ্বাস নেই তখন।

লেখক, ফারহানা নিশি
শিক্ষার্থী, ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ

ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ