লাইভ প্রতিবেদক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে যেনতেনভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ট্রাস্টিবোর্ডের পুরো নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকটা যেন পুতুলের মতোই থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসিসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। কথার বাইরে গেলেই তাদের চাকরি হারাতে হয়। আবার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যরা। ঘুরেফিরে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই যান শীর্ষ পদে। বর্তমানে দেশের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতেই নেই ভিসি পদ। ৭০টিতে প্রো-ভিসি এবং ৫০টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি আছেন, তাদের অধিকাংশই নামকাওয়াস্তে। সেখানে ট্রাস্টি বোর্ডই সব। সব কলকাঠি নাড়েন বোর্ডের সদস্যরা। তাদের কথার বাইরে গেলেই সর্বনাশ। চাকরি হারাতে হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ বলা হয়েছে, ভিসি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী ও একাডেমিক কর্মকর্তা হবেন। তিনি সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দায়ি থাকবেন। এছাড়া সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিলসহ বিভিন্ন কমিটির প্রধানের দায়িত্বেও থাকবেন ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, শিক্ষকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ কমিটির সভাপতিও হবেন ভিসি।
আইনে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সরঞ্জাম অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, সিন্ডিকেটের সুপারিশক্রমে পদ সৃষ্টি, নিয়োগসংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন, শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণ, সিন্ডিকেট কর্তৃক সুপারিশকৃত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট অনুমোদন ইত্যাদি। সিন্ডিকেটের সুপারিশে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ের অনুমোদন দেবেন, তবে সিন্ডিকেটের প্রধান থাকবেন ভিসিই। অথচ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা নথিপত্র তৈরি করে দিচ্ছেন, ভিসিরা শুধু স্বাক্ষর করেন। কোনো ধরনের আর্থিক কার্যক্রমে ভিসিদের ভূমিকা নেই। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক হলেও সেটা এখন পুরোপুরি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এই আর্থিক বিষয়ের পুরো দায়িত্বেই থাকেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। এমনকি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিসিদের কক্ষ থেকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের কক্ষ অনেক উন্নত মানের।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ৯৪টিতে ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ পদ থাকা উচিত। গত ২৮ আগস্ট ইউজিসি প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকায় দেখা যায়, ২৩টি প্রতিষ্ঠান ভিসি ছাড়া চলছে। প্রো-ভিসি নেই ৭০টিতে, ৫০টি কোষাধ্যক্ষহীন।
এসবের বেশির ভাগই চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব পদে নিয়োগ দিতেই আগ্রহী নয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষে সনদও ইস্যু করছেন ভারপ্রাপ্তরা।
ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জেনেশুনেই ভিসির জন্য এমন সব নাম পাঠায় যে তাতে দেরি হয়। একজন ভিসি, প্রো-ভিসির জন্য কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন তা তাদের জানা। এমনকি তিনজনেরই সব ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে। কিন্তু অনেকে ইচ্ছা করেই যোগ্যতার ঘাটতি রেখে নামের তালিকা পাঠায়। তাদের চিন্তা থাকে যত দিন দেরি করা যায়।
তিনি বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। আবার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রয়েছে বোর্ড অব ট্রাস্টি, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটি। আইনে এসব কমিটির সভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। ২০১৭ সালে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। ১১টিতে সিন্ডিকেট সভা, আটটিতে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা এবং ১৩টিতে অর্থ কমিটির সভা হয়নি।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসির নামমাত্র ভূমিকা থাকায় তাদের আয়-ব্যয়ও স্বচ্ছ নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আয়-ব্যয় সমান। অনেক শিক্ষার্থী থাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে। আয়-ব্যয় কিভাবে সমানে সমান হয় তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা যায়, রাজধানীর একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে প্রায় ২০ বছর ধরে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র একজন ভিসি তার নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের কথা না শোনায় উপ-উপাচার্যকেও কিছুদিন আগে চাকরি হারাতে হয়েছে। রাজধানীর উত্তরার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির কিছু ক্লাস নেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্বই দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায়ই ওই শিক্ষক দুই বছর পার করছেন। বাকি সময়টা কিভাবে পার করবেন সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন। বনানীতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এমন এক ভিসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আবার রাজধানীতেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে দুই দফা দায়িত্ব পালনের পরও কেউ কেউ ভারপ্রাপ্ত পদসহ ১৫ থেকে ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বড় বড় পদে বসিয়ে নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত দুটি, ধানমণ্ডিতে অবস্থিত দুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে সবাই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে একজনই বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান। আর বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যই তার পরিবারের। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের বড় অংশ বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে নিজেদের পকেটে ঢোকাচ্ছেন।
[কার্টেসি : কালেরকণ্ঠ]
ঢাকা, ০৮ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: