শান্তনা রহমান: পদের একটা মজাই আলাদা। তা যদি হয় ক্ষমতাসীন দলের। তাহলে তো কোন কথাই নেই। এমন লোভ পেয়ে বসেছে বলে মন্তব্য খোদ ছাত্রলীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতার। তারা বলেছেন আমরা মেয়াদ উত্তীর্ন কোন কমিটি দেখতে চাই না। ২ বছরের কমিটি ৪ বছর হলেও সম্মেলন করার কোন উদ্যোগ নেই। আমরা তাদের বাধ্য করেই সম্মেলনের ঘোষণা নিয়েছি। ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের কমিটি নিয়েই যত ঝামলো। এই ৩ সংগঠনের মেয়াদ উত্তীর্ন হয়েছে।
আমাদের নেত্রীও আমাদের সমর্থনে সম্মেলনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। এ সব কেবল ছাত্রলীগে নয় মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের কমিটি গঠন নিয়েও চলছে দলের ভেতরে নানান গুঞ্জন। নানান চাপ। আড়াই বছর আগে মেয়াদ শেষ হলেও আটকে আছে আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী- সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ এবং ছাত্রলীগের সম্মেলন।
দেশের বিভিন্ন ইউনিটে এনিয়ে নানান ঝামেলা তো লেগেই আছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন দ্বন্দ দেখা দিচ্ছে নিজেদের ভেতরে। দলীয় ক্ষোভ ও দ্বন্দ বেড়েই চলেছে। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্মেলনের তারিখ বেঁধে দিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে লিখিত আবেদন দিয়ে রেখেছেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিলেই সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হবে।
তবে সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পদ ধরে রাখতে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে সময়ক্ষেপণসহ টালবাহানার অভিযোগ উঠেছে। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের নির্দেশের পরও সম্মেলনে আগ্রহী নয় এ ৩ সংগঠনের নেতারা। মেয়াদোত্তীর্ণ তিন সংগঠনের সম্মেলন নিয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর নির্ধারিত তিন বছরের মেয়াদও শেষ হতে চলেছে।
সংশ্লিস্টরা বলছেন, এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোতেও নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সাংগঠনিক গতি ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই যত শিগগির এ কাজটি করা যায় তাই ভাবছেন শীর্ষ নেতারা। একারণে মেয়াদোত্তীর্ণ এই তিন সংগঠনের সম্মেলন শেষ করতে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা।
জানাগেছে সর্বশেষ গত ৭ মে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় দলের ২২তম জাতীয় কাউন্সিলের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন শেষ করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখন সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোন লক্ষন চোখে পড়ছে না। এর পর ১০ মে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই তিন সংগঠনের সম্মেলন আয়োজনের নির্দেশ দেন।
তিনি সংগঠনগুলোকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে যোগাযোগ করে এবং দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে সময় নিয়ে সম্মেলনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করতে বলেছেন। বিশেষ করে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রলীগ সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে দু-একদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দপ্তর সেলে যোগাযোগ করে তারিখ নির্ধারণের কড়া নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ওই নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়া খাতুন ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক এবং যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সম্মেলনের তারিখ বেঁধে দিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে লিখিত আবেদন জমা দেন। ওই চিঠিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তাঁরা।
তবে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এমন কোনো চিঠি না দিয়ে বরং 'আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি' দাবি করে এ নিয়ে সময়ক্ষেপণ করে আসছেন বলে নানান অভিযোগ করছেন অনেক নেতা। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের উপ-প্রশিক্ষণ সম্পাদক মেশকাত হোসেন বলেন, ‘বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও তারা (জয়-লেখক) সম্মেলন দিচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও তারা সম্মেলন পেছানোর চেষ্টা করছেন। একবার আমরা মধুর ক্যান্টিনে তাদের অবরুদ্ধ করি। পরে দুজনই দ্রুত সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার কথা জানান।’
ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ‘দলের সাধারণ সম্পাদক নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন তারিখ দেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে জয় ও লেখক বলেন ‘সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত, এটি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত না।’ পরে আমাদের তোপের মুখে তারা স্বীকার করেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথায় ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন শিগগিরই সম্মেলনের তারিখ দেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে। সম্মেলনের আড়াই মাসের বেশি সময় পর একই বছরের ৩১ জুলাই তাঁর ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম রাব্বানীর নাম ঘোষণা করেন।
এরও ১০ মাস পরে ২০১৯ সালের ১১ মে ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন দুই শীর্ষ নেতা। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার কাজে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের।
ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়কে। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য হন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। পরে ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাঁদের পূর্ণ দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা। তখন বলা হয়েছিল, তাঁরা শোভন-রাব্বানীর অবশিষ্ট মেয়াদের ১০ মাস অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু দুই বছর মেয়াদি ওই কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে প্রায় দুই বছর দুই মাস আগে।
বিতর্কমুক্ত সংগঠন গড়ার প্রত্যয়ে আল-নাহিয়ান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে ছাত্রলীগের মূল দায়িত্বে আনা হলেও এই দুই নেতাই এখন নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠন পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবমূল্যায়ন, পদবাণিজ্য, সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন কমিটির কলেবর বৃদ্ধি, বিবাহিত-চাঁদাবাজ-মাদকসেবী-ছাত্রদল ও শিবিরের কর্মীদের কমিটিতে আনা প্রভৃতি অভিযোগে সোচ্চার হয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
সম্মেলনপ্রত্যাশী এসব নেতার অভিযোগ, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পদ ধরে রাখতে সম্মেলন অনুষ্ঠান বিষয়ে চূড়ান্ত রকমের অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন জয় ও লেখক। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছর সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রমই চালাতে পারেননি। করোনা শেষে এখন পুরোদমে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে অনেকটাই গুছিয়েও এনেছেন।
তবে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই থেকে আড়াই বছর আগে। বাকি সংগঠনগুলোর মধ্যে সিংহভাগের মেয়াদও আগামী নভেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় আগের মেয়াদোত্তীর্ণ সংগঠনগুলোর সম্মেলন করা না গেলে পরবর্তী সময়ে সহযোগী সংগঠনগুলো সম্মেলনজটে পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানাগেছে মেয়াদোত্তীর্ণ সংগঠনগুলোর মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অর্থাৎ পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ৪ মার্চ। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ৩ মার্চ, অর্থাৎ আড়াই বছরেরও বেশি সময় আগে। সম্মেলন না হওয়ায় নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম, চলছে স্থবিরতা। তেমন কোন কাজ নেই। কর্মীদের মাঝে নেই উৎসাহ। কেবল আখের গোছাতেই ব্যস্ত নেত্রীরা।
এদিকে যুব মহিলা লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে আড়াই বছর আগে। এ সময়ের মধ্যে পাপিয়াকান্ড সহ নানা বিতর্কে জড়িয়েছে সংগঠনটি। আবার দুই শীর্ষ নেতার দীর্ঘদিন একই পদে 'আঁকড়ে থাকা' এবং পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ নিয়ে সংগঠনের ভেতরে অস্থিরতা চলে আসছে।
পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলোর দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে প্রায়ই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্ম হচ্ছে। তাদের অনেকেই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এনিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানান ক্ষোভ। যারা ঠিকমতো সম্পর্ক রাখতে পেরেছে তারা হয়েছে লাভবান। আরা যারা সম্পর্ক রাখতে গিয়ে নানান সমস্যাূয় জড়িয়েছেন তারা এখন ক্ষুদ্ধ। তারা মেয়াদউত্তীর্ন কমিটিকে আর সহ্য করতে পারছেন না। ফলে হর-হামেশাই লেগে আছেন নানান দ্বন্দ ও সংঘাত।
এ ব্যাপারে আগামী সম্মেলনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই তাঁরা সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে দিতে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। এখন নেত্রী (শেখ হাসিনা) তারিখ দেওয়া মাত্রই সম্মেলন ঘোষণা করা হবে।
যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তারও একই কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, করোনা সংকটের সময়টুকু ছাড়া সবসময়ই সম্মেলনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই তো চলেছেন তাঁরা। এখনও ধারাবাহিকভাবে সংগঠনের জেলা সম্মেলনগুলো চলছে। যখনই জাতীয় সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হবে, তখনই সম্মেলন করা হবে। আমরা এর কোন ব্যত্যয় ঘটুক তা চাই না।
ঢাকা, ১০ সেপ্টেম্বর(ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: