Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

প্রেক্ষাপট: শিক্ষক আন্দোলন

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বার ২০১৭, ০২:৫৫


মো: আবুল বাশার হাওলাদার: দেশের শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছেন। শিক্ষকতাকে তাঁরা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নিয়োজিত বিশাল এক শিক্ষকগোষ্ঠী। সব মিলিয়ে ৫ লক্ষাধিক শিক্ষক ও ১ লক্ষাধিক কর্মচারি কর্মরত আছেন এসকল প্রতিষ্ঠানে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেখা যায়, রাজধানী ও বিভাগীয় শহরসহ জেলা-উপজেলার কেন্দ্রে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। এখনও শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণ হচ্ছে গেজেটের মাধ্যমে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধার বৈষম্য দিনদিন চরম আকার ধারণ করছে। নানাভাবে বঞ্চিত বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করে আসছেন।

১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে দেশব্যাপী শিক্ষক আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯০ দিন লাগাতার ধর্মঘট পালিত হয় এবং এই আন্দোলনে শিক্ষকদের বেতন ৫০ টাকা থেকে ৭৫ টাকায় উন্নীত হয়। এরপর ১৯৮৫ খ্রীস্টাব্দে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে বেতন ৫০% থেকে ৭০%-এ উন্নীত হয়। তখনও শিক্ষকরা চাকুরি শেষে শূণ্য হাতে বিদায় নিতেন করুণ অবস্থার মধ্যে।

১৯৯০ খ্রীস্টাব্দে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারি অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারি কল্যাণ ট্রাস্ট নামে দুটি বিল সংসদে পাস হয় বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য। কিন্তু তা কার্যকর হতে সময় লেগেছে অনেক। অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট যথাক্রমে ৪% ও ২% চাঁদা কেটে নেয় শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ থেকে।

কিছুদিন পূর্বে উক্ত দুটি বোর্ডের সভায় আরো ২% করে কেটে নেয়ার হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রণালয়। শিক্ষকদের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন কর্তৃপক্ষ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বোর্ডসভায় উপস্থিত শিক্ষক-কর্মচারি নেতৃবৃন্দ অতিরিক্ত চাঁদা কর্তনের সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করে এসে শিক্ষক কর্মচারিদের চাপে তা অস্বীকার করেন এবং আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন।

আমার জানামতে কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অবসরভাতার জন্য চাঁদা কর্তনের বিধান নেই। আমরা মেনে নিয়েছিলাম তার কারন হলো, একসময় কিছুই পেতাম না; চাঁদা দিয়ে হলেও যদি কিছু পাওয়া যায়।

১৯৯৪ খ্রীস্টাব্দে শিক্ষক-কর্মচারিদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রায় সব সংগঠন এ আন্দোলনে অংশ নেয়। তিনদিনব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয় প্রেস ক্লাবের সামনে। লক্ষাধিক শিক্ষক এ আন্দোলনে অংশ নেন।

এমনকি রাজধানীতে অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হয়। ১০% বেতন ও একটি টাইম স্কেল পেয়েই শিক্ষকরা সন্তুষ্ট থাকেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে বেতন ১০০%-এ উন্নীত হয় এবং ২৫% উৎসব ভাতা, এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা মেডিকেল পাওয়া যায়।

তবে এর জন্য তীব্র কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এর কারন হলো, বর্তমানে শিক্ষক সংগঠনের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ সক্রিয় রাজনীতি করেন। তাছাড়া শিক্ষক নেতারা নিজস্ব কোন্দলে জড়িয়ে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন সংগঠন তৈরি করছেন। এতে সাংগঠনিক শক্তি দিনদিন কমে যাচ্ছে।

ইদানিং দেখা যাচ্ছে, শিক্ষক-কর্মচারিরা শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এক দফা দাবি নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। শিক্ষা জাতীয়করণ, শিক্ষাব্যবস্থা, জাতীয়করণ, চাকুরী জাতীয়করণ, সরকারিকরণসহ নানা শিরোনামে ব্যানার, লিফলেট তৈরি করছে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন।

তবে ভাষা যাই হোকনা কেনো, সকলের মনের কথা একই-বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হচ্ছে; এখানে চাকুরি বা শিক্ষা জাতীয়করণের কথা বলা হচ্ছেনা। আমার মনে হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণই বলা সঠিক হবে।

আবার একদফা দাবিরও ভিন্নতা আছে; কেউ শুধুমাত্র মাধ্যমিক, কেউ সকল স্তরকে জাতীয়করণের কথা বলছেন। তাই একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য সংগঠনগুলো জোটবদ্ধ হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪টি জোটের কথা শোনা যাচ্ছে।

কেউ সমমনাদের নিয়ে, কেউ বলছেন আদর্শিক, কেউ বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সংগঠন নিয়ে জোট করা হচ্ছে। তবে আবার সবাই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জোট বলছেন। এ নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি কম হচ্ছে না। তাছাড়া নিজ নিজ জোটের শক্তি ও জনবল প্রদর্শনেরও চেষ্টা কম নয়। নতুন নতুন সংগঠনের সৃষ্টি হচ্ছে অন্যের প্রতি আস্থা না থাকার জন্য বা নেতা হওয়ার জন্য। কোনো কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে একদফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য।

অন্যথায় প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘট পালন ও পাবলিক পরীক্ষা বর্জন করার হুমকি দেয়া হয়েছে। কোন কোন জোট এখনো কর্মসুচি ঘোষণা করেনি। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে কোনো কোনো নেতা আন্দোলন থেকে ফসকে যেতে পারেন আশংকা করা হচ্ছে। তাই জোটগুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

শিক্ষক-কর্মচারিরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন যাতে খুব সহজেই দাবি আদায় করা যায়। তবে এটাও শোনা যাচ্ছে, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ শুধু আন্দোলনের মাধ্যমেই নয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করছেন যাতে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে এ দাবি পূরণ করা যায়।

১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণ করেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো ২৬ হাজার প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করেন এবং তিঁনিই পারবেন বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয়করণ করতে আমার বিশ্বাস।

স্বাধীনতার ৪২ বছর পর হলেও জাতির প্রাণের দাবি শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়েছে। তাছাড়া ডিজিটালাইজড শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তবে আলোর মধ্যে অন্ধকার দেখা যাচ্ছে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ধীর গতি। যদিও শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয় জোর দিয়ে বলছেন, শিক্ষানীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি, শিক্ষানীতির মূল আকর্ষণ তিনস্তর বিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। সবাই বলতে পারবেন এর অগ্রগতি কতদূর।

মনে হয়, শিক্ষামন্ত্রণালয় এই নীতি থেকে সরে যাচ্ছেন। ২০০৯ খ্রীস্টাব্দে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিভিন্ন গণমাধ্যমে, সভা-সেমিনারে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের কথা বলে আসছেন জোরালোভাবে। এখন আর তিঁনি একথা বলেন না- আমরা শিক্ষকরাও ভুলে গেছি সেকথা।

পূর্বের কথায় ফিরে যাই, শিক্ষক আন্দোলন মনে হচ্ছে জোরেশোরেই এগোচ্ছে। কেউ ইচ্ছে করলেই এখান থেকে পেছনে যেতে পারবে না। সাধারণ শিক্ষকরা এখন ঐক্যবদ্ধ। তবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা কারো কাম্য নয়।

এব্যাপারে সরকার ও শিক্ষকদের সমঝোতায় আসতে হবে। আন্দোলন করা শিক্ষকদের পেশা নয়। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় থেকে ধ্বংসাত্মক কোনো আন্দোলন করা সমীচীন নয়।

তবে শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের বিকল্প নেই। নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে। শিক্ষা জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি-- জাতীয় দাবি।

 

মো: আবুল বাশার হাওলাদার
সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন


ঢাকা, ০৯ ডিসেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ