Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

ধর্ষণ বিষফোঁড়ার মতই যন্ত্রনাদায়ক

প্রকাশিত: ২৪ আগষ্ট ২০১৭, ০৬:০৭

মো: শাফায়েত হোসেন: বিষফোঁড়া একটি বিশেষ্য পদ৷ যে ফোঁড়া বিষিয়ে ওঠে বা যন্ত্রনাদায়ক তাকে অামরা বিষফোঁড়া হিসেবেই জানি৷ তেমনি ধর্ষণ ও আমাদের সমাজে বিষফোঁড়ার মতই বিষিয়ে বা যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠেছে৷

পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ বোলালেই দুই-তিনটা ধর্ষণের খবর প্রতিদিনই চোখে পড়ে৷ প্ৰথম যখন পত্রিকা পড়া শুরু করেছিলাম তখন ধর্ষণের খবরগুলো কৌতূহল বশত একটু মনোযোগ দিয়েই পড়তাম৷ এখন আর পড়তে তেমন মন চায়না৷

তার কারণটা আমার কাছে মনে হয় যে আমরা যখন কোন মারাত্মক ঘটনা বার বার ঘটতে দেখি তখন আমরা ঐটা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাই এবং এক সময় আমরা সেটাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেই বা বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হয়৷ কিন্তুু যতই আমরা নিজেদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করিনা কেন, ধর্ষণ যে বিষফোঁড়ার মতই যন্ত্রনাদায়ক সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন যিনি ধর্ষিত হন এবং বুঝতে পারেন তার পরিবার৷

একটি মেয়ে যখন ধর্ষিত হন তখন সে হয় সামাজিকভাবে হেনস্থার শিকার, বিচার প্রক্রিয়ায়া হয় বিলম্বিত, দেখা দেয় প্রতিবন্ধকতা আর তাকে মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে করা হয় আরও একবার ধর্ষন যেটাকে তার কাছে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতই মনে হয়৷


সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ যে কত ভয়াবহ আকার হয়ে উঠেছে তার বড় উদাহরণ পত্র-পত্রিকার সংবাদগুলো আর যে গুলো পত্রিকার সংবাদে আসেনা সেগুলো তো পরিসংখ্যানের বাইরেই থেকে যায়৷ উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই, বগুড়ায় ক্যাডার দিয়ে তুলে ছাত্রী ধর্ষণ এবং নির্যাতনের পর মা ও মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয় তুফান সরকার নামে এক ঝড়ো হাওয়া ব্যক্তি যেটা মধ্যযুগীয় সময়কেও হার মানায়৷

এই ঘটনাটি দেশ ব্যপি তোলপাড় সৃষ্টি হলেও দুবৃত্তরা যে মোটেই নিবৃত্ত হয়নি তার প্রমাণ ঢাকা, নারায়নগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এক পর এক ধর্ষণের ঘটনা৷ গত ২৮ মার্চ বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাটি দেশ ব্যপি আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ এই মামলাটি নিয়ে শুরু হয় নানা ধরনের হয়রানিমূলক কার্যকলাপ৷ যদিও মামালাটি করা হয় ঘটনার চল্লিশ দিন পর৷ বর্তমানে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠানো হয়েছে।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ ধর্ষনের শিকার হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু৷ এই তনু হত্যার এক বছর পরেও ধরাছোঁয়ার বাইরে অপরাধীরা ৷ এই রকম প্রতিদিনই ধর্ষনের পর হত্যার শিকার হচ্ছেন তনুর মত হাজারো তনু৷ আর তারা সঠিক বিচার পাবার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক দ্বার থেকে অন্য দ্বারে ৷ পোহাতে হচ্ছে বিড়ম্বনা৷ এই ধরনের হাজারো ধর্ষনের ঘটনা আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা ৷

বাংলাদেশে ধর্ষনের সংখ্যা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার একটি বড় প্রমান হল ১৪ টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল এই আট বছরে ধর্ষনের শিকার ৪৩০৪ জন৷ আর ২০১৬ সালেই ধর্ষনের শিকার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি ৷

একটি সনামধন্য পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন ২০১৭) সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১১০৯টি। এ তথ্য খোদ পুলিশ সদর দফতরের। আর বছর ভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষনের শিকার ২০০৮ সালে ৩০৭ জন, ২০০৯ সালে ৩৯৩ জন, ২০১০ সালে ৫৩৩ জন, ২০১১ সালে ৬৩৫ জন, ২০১২ সালে ৫০৮ জন, ২০১৩ সালে ৫১৬ জন, ২০১৪ সালে ৫৪৪ জন এবং ২০১৫ সালে ৮০৮ জন৷

এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আমাদের দেশে ধর্ষণ বাড়ছে নাকি কমছে ৷ আর এভাবেই যদি চলতে থাকে যে দশটি দেশ ধর্ষণের শীর্ষে আছে আমরা অচিরেই ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে যাচ্ছি যাদের কেবলমাত্র সরকারী হিসেবেই লাক্ষে ৫৩.২ শতাংশ নারী ধর্ষিত হয় সুইডেনে, ৪০ শতাংশ নারী ধর্ষিত হয় দক্ষিন আফ্রিকায়, প্রতি তিনজন নারীর একজন যৌন হেনস্থার শিকার হয় আমেরিকায়, প্রতি বছরে ৮৫ হাজার ধর্ষনের শিকার হয় ইংল্যান্ডে, প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয় ভারতে, নিউজিল্যান্ডে প্রতি চারজন নারীর একজন ধর্ষনের শিকার হয়, কানাডায় ছয়জন নারীর একজন নারী ধর্ষনের শিকার হয়, অস্ট্রেলিয়া , ডেনমার্কে ৫২ শতাংশ নারী এবং ফিনল্যান্ড ৩৭ শতাংশ নারী ধর্ষনের শিকার হয় ৷ এবার ভেবে চিন্তে দেখি আমরা কি চায় কই যায়৷ ভাবতে থাকুন! ভাবতে থাকি!


এইটা মহামারী আকার ধারন করার কিছু কারণ আছে, তার আগে বলে নেই আমাদের শরীরে বিষফোঁড়া তখনই ওঠে যখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে, তেমনি ধর্ষণও আমাদের সমাজে তখনই বৃদ্ধি পায় যখন আমাদের সমাজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় অর্থাৎ সমাজের নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, ন্যায় বিচার, সুশাসন বাধাগ্রস্থ হয়৷

ধর্ষণের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে আমরা কিছু পুরুষের মানসিকতাকে দায়ী করতে পারি কারণ আমাদের সমাজে নারীর প্রতি কিছু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন ৷ তারা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই মনে করে৷ ধর্ষণের কারণ হিসেবে মাদকাসক্তিও কম দায়ী নয় বগুড়ায় ছাত্রী ধর্ষণকারী তুফান সরকার একজন নিয়মিত মাদকাসক্ত ব্যক্তি ৷

বাইরে থেকে জেলখানায় তুফান সরকারের জন্য মাদক সরবারহ করার কারণে তাকে বগুড়া থেকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে ৷ একজন মানুষ যখন মাদক সেবন করেন তখন তার মস্তিষ্ক হয়ে যায় বিকৃত তখন তিনি জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন ধরনের অপরাধে ৷ নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান বলে মনে করা ধর্ষনের আরও একটি অন্যতম কারণ হতে পারে ৷ যিনি নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান মনে করেন তিনি চিন্তা করেন কোন অপরাধ করলে তার কোনো শাস্তি হবেনা কারণ তার রয়েছে উপরওয়ালাদের সাথে যোগাযোগ৷


ধর্ষনের কারন হিসেবে অনেকে মনে করেন নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাকই দায়ী আমার মনে হয় এই কারণটি কিছুটা ঠিক আবার কিছুটা ঠিক নয় ৷যেমন, যখন পাঁচ বছরের একটি শিশু ধর্ষন হয় তখন আমরা ঐটাকে কি বলব? মেয়েটির পোষাক দায়ী নাকি আমাদের বিকৃত মানসিকতা দায়ী৷ আমি এখানে এটা বলতে চাচ্ছিনা যে আমাদের মা-বোনেরা অশ্লীল পোষাক বা সংক্ষিপ্ত পোষাক পরে চলাফেরা করুক৷ তারা অবশ্যই শালীন পোশাক পরবে৷ধর্ষন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়াও কম দায়ী নয়৷ দরজা খুলে ঘুমালে যেমন চোর চুরি করতে পারে, তেমনি চুরি করা চোর ধরা পড়ার পরে বিচার না হলে চোর আবার চুরি করে এবং সমাজে চুরি বেড়ে যায়। কাজেই শুধু দরজা খুলে ঘুমানো লোক কে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বিচার ব্যবস্থারও দোষ রয়েছে ১৬ আনা। তাছাড়া জৈবিক চাহিদা মেটানোর অপর্যাপ্ততা এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুকেও ধর্ষনের কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে৷


তাহলে এভাবে যদি ধর্ষন দিন দিন বাড়তে থাকে তাহলে এটা থেকে আমরা কিভাবে বেরিয়ে আসতে পারি বা আমাদের করণীয় কি? আমার মতে শরীরে যখন বিষফোঁড়া বাড়তে থাকে তখন এটাকে দমনের জন্য এন্টিবায়োটিক ওষুধের দরকার হয় তেমনি এই ধর্ষণ নিয়ন্ত্রন করার জন্যও এন্টিবায়োটিক দরকার আর সেটা হলো হাইয়ার এন্টিবায়োটিক অর্থাৎ ধর্ষণকারীর উপস্থচ্ছেদ বা ক্যাষ্ট্রেশন করা যেতে পারে৷

যদিও বাংলাদেশের আইনে ধর্ষনের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে ৷ আর এই শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও ধর্ষন যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন শাস্তির বিধানটা অবশ্যই কঠিন করা উচিত৷ আবার অনেক সময় দেখা যায় আইন আছে কিন্তুু আইনের বাস্তবায়ন নেই তাই আইনের বাস্তবায়নটাও খুব জরুরী৷ সর্বপরি বলতে পারি অনেক সময় কঠিন শাস্তি দিয়েও অপরাধ কমানো সম্ভব হয়না ৷

একটি সমাজে নৈতিকতা, মুল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসনগুলো যদি ঠিক থাকে তাহলেও অপরাধ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব সেজন্য দরকার সমাজে নৈতিকা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলা৷ তাহলে কিছুটা হলেও ধর্ষণের সংখ্যা আমাদের সমাজ থেকে হ্রাস করা যেতে পারে৷ ধর্ষণের ভয়াবহতা হাত থেকে বাঁচতে আমাদের অবশ্যই জনমত গড়ে তুলতে হবে এবং বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যগে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও প্রতিটি ওয়ার্ডে ধর্ষণের ভয়াবহতা,শাস্তি এবং এটার বিভিন্ন নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করা যেতে পারে৷


পরিশেষে বলতে চায় এই বিষফোঁড়াকে আমাদের সমাজ থেকে দূর করতে হলে সামাজিক জন সচেতনতার পাশাপাশি দরকার সকল মানুষের ধর্ষণের বিপক্ষে অহস্থান আর সেই পাশাপাশি আরও দরকার ক্ষমতাসীন দলের সহায়তা৷ তাহলে আমাদের মা -বোনেরা বা আর কোন পরিবার কাতরাবেনা এই বিষফোঁড়ার মত যন্ত্রনাময় যন্ত্রনা থেকে৷ আর আমাদের সমাজ হবে বিষফোঁড়া মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ৷


মো: শাফায়েত হোসেন
এম এস এস শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা, ২৩ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমএইচ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ