Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

আবু বকর : যশোরের যশ পুনরুদ্ধারের একজন সংগঠক

প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারী ২০২২, ০৮:৪২

বি এম ইউসুফ আলী : আবু বকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করছেন। ইতোমধ্যে বিবিএ শেষ করেছেন। এখন এমবিএ করছেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মোহাম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র। বাড়ি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামে।

"যশোরের যশ খেজুরের রস "। যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস, গুড় ও পাটালীর হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন আবু বকর। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে তার সাথে দেখা হয়। কখনো দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে আবার চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতেই তার সাথে এ বিষয়ে আমার নানা রকম আলাপ হয়।

একপর্যায়ে জানতে চাইলাম, কীভাবে যশোরের যশ খেজুরের রসের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে কাজের সাথে যুক্ত হলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, "মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে আমি বাড়িতে চলে যাই। হাতে বিস্তর সময়। গ্রামে মাঠেঘাটে ঘুরিফিরি। একসময় হঠাৎ মাথায় এলো যশোরের পথে ঘাটে, বাড়ির উঠানে অতীতে যে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ ছিল তা আজ আর নেই।

তিনি আরো বলেন, খেজুর বাগানের দৃশ্যও খুব কম দেখা যায়। পূর্বে শতকরা ৫০/৬০টি পরিবারেই খেজুরের গাছ ছিল। এখন তা শতকরা ২/৩ ভাগে নেমে এসেছে। গত কয়েক বছর আগে যে পরিমাণ গাছ যশাের এলাকায় ছিল তার বেশির ভাগ কেটে ফেলা হয়েছে।

তাছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসাধু ব্যবসায়ীরা যশোর থেকে গুড় পাটালি কিনে তাতে চিনি সোডা হাইড্রোজ ফিটকিরি মিশিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে যশোরের খেজুর গুড় ও পাটালির ব্রান্ড নাম ব্যবহার করে বিক্রি করে এতে করে কিন্তু দেশের মানুষের কাছে আমাদের যশোরেরই সুনাম নষ্ট হয়। তখন আমার ভাবনায় চলে আসে কীভাবে ভেজালমুক্ত গুড় পাটালি সরবরাহ করে যশোরের পজিটিভ ইমেজ তৈরি করা যায়। সেই থেকে শুরু।"

এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম যশোরের রস, গুড় বা পাটালি অন্যান্য এলাকার গুড় পাটালির থেকে সুস্বাদু, সুগন্ধি ও মজাদার কেন? তিনি উত্তরে বলেন, "ইউসুফ ভাই। আপনার বাড়িও যশোর। আপনিও জানেন আমাদের এলাকার গাছিরা অন্য এলাকার থেকে ভিন্নভাবে গাছকাটে। যশোর অঞ্চলের গাছিরা একই স্থানে বারবার চেঁচে রস সংগ্রহ করে না। প্রতিবার রস সংগ্রহের জন্য আলাদা স্থানে অর্থাৎ স্টেপ বাই স্টেপ করে গাছ কাটে। যার কারণে প্রতিবারেই রস সতেজ বা জিড়েন রস পাওয়া যায় এবং তা মনে হয় নলেন রস বা গুড়।"

আবু বকর ও বি এম ইউসুফ আলী

গাছিরা কেন ভেজাল দেয় জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন, "এক ভাড় (ঠিলে/হাড়ি) রস বাজারে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তাতে গুড় হয় ৭/৮ শ গ্রাম। তাছাড়াও সময়, জ্বালানি ও ঝামেলা পোহাতে হয় অনেক। আমরা কম দামে কিনতে চায় বলেই গাছিরা চিনি ভেজাল দিয়ে গুড় পাটালির পরিমাণ বৃদ্ধি করে কম দামে বিক্রি করছে। আসলে তারা যাবে কোথায়? দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের গলিত রস থেকে উৎপাদিত গুড়ের (যেটা টক/উলা গুড় ) সাথে জিড়ন রসের গুড় মিশিয়ে দিয়ে দেয়। জিড়েন রসের গুড় পাটালি স্বাদ আলাদা। সুঘ্রাণযুক্ত।"

আচ্ছা, একজন ক্রেতা কীভাবে বুঝতে পারবেন কোন গুড় বা পাটালি ভেজালমুক্ত? এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু বকর বলেন, "আসল গুড় বা পাটালি স্বাদে অতিরিক্ত মিষ্টি হবে না। পাটালি হবে নরম। গালে দিলে দ্রুত গলে আসে।"

যশোরে কী কী ধরনের গুড় বা পাটালি তৈরি করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যশোরে উপজেলা ভিত্তিক গুড়ের ধরনে পার্থক্য আছে। মেদি দানা গুড়, মিছরি দানা গুড়, ঝোলা গুড়, চামটানা গুড়, শক্ত গুড়। আর পাটালি মধ্যে রয়েছে দানা পাটালি, বালি পাটালি, নারিকেল পাটালি, তিল পাটালি। অনেকে নাড়ুও তৈরি করে থাকেন।"

খেজুরের গুড় ও পাটালি কেনার পর দেখা যায় তার গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। কীভাবে সংরক্ষণ করলে অনেক দিন পর্যন্ত কোয়ালিটি ভালো থাকবে ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, "গুড় বা পাটালি কাঁচের বা মাটির পাত্রে রাখলে ভালো থাকে। আর প্লাস্টিকের পাত্রে রাখলে তা প্লাস্টিকের গন্ধ গুড়ে যুক্ত হয়ে গুড়ের কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যেতে পারে"।

হাঁটতে হাঁটত তখন বিশ্বিবদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে চলে এসেছি। দোকান থেকে নাস্তা করে চলে এলাম ডাকসু পাশে। চায়ের অর্ডার দিয়ে সেখানে বসে গেলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তার কাছে প্রশ্ন রাখলাম, যশোর অঞ্চলে খেজুরের গাছ কেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে? উত্তরে তিনি বলেন, "আমি এখন পর্যন্ত ২৯৩ জন গাছির সাথে সাক্ষাত করেছি। তার মধ্যে মাত্র ৭/৮ জনকে পেয়েছি যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। অধিকাংশ গাছির বয়স ৫৫ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ প্রবীণরাই এখনও টিকিয়ে রেখেছে খেজুরের গুড় ও পাটালি উৎপাদন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বয়স্ক গাছিরা মারা গেলে এই পেশার হাল ধরবে কে ? অর্থাৎ বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কিন্তু এই কষ্টের পেশায় আসছেন না। আসবে কেন ? মানুষ এখন অল্প পরিশ্রমে অনেক বেশি টাকা পয়সা ইনকাম করতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে বয়স্ক গাছিরা মারা গেলে কারা এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হাল ধরবে? এটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। যেহেতু গাছ কাটার গাছি পাওয়া যাবে না, অন্যদিকে খেজুর গাছ ফসলি জমির বেশ ক্ষতি করে ফলে গাছ মালিকরা বাধ্য হয়ে গাছ কেটে ফেলছে।

আরেকটা বিষয়, ইটভাটার জন্য এই খেজুর গাছ কিন্তু উন্নত ও মূল্য সাশ্রয়ী জ্বালানি। সব মিলিয়ে বড় হুমকির মুখে পড়েছে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস গুড় পাটালী অর্থাৎ এইভাবে দিনদিন খেজুরের গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।"

আমি জেনেছি আপনি "গাছি বাঁচলে বাঁচবে ঐতিহ্য, ঐতিহ্য বাঁচলে বাঁচবে দেশ" এই স্লোগান দিয়ে যশোরের ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন করছেন এবং সবাইকে আপনার পাশে থাকার অনুরোধ করেছেন। এই আন্দোলন কীভাবে শুরু করেছেন?

এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, "আপনাকে আগেই বলেছি আমি এ পর্যন্ত ২৯৩ জন গাছির সাথে কথা বলেছি। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনরাত গাছিদের পিছনে ব্যয় করেছি। তাদেরকে সংগঠিত করছি এবং তারা যাতে গুড় ও পাটালিতে ভেজাল না দেয় সে ব্যাপারে সচেতন করেছি। এমনকি তারা যাতে ন্যায্য মূল্যে তা বিক্রি করতে পারেন সে ব্যবস্থাও করেছি। এলাকার গাছ মালিকদের সাথেও আলোচনা করে গাছ কেটে না ফেলার অনুরোধ করেছি। সংবাদকর্মী ও সচেতন মহলের সাথেও আলাপ করেছি।

গাছিদের সঙ্গে ঢাবি শিক্ষার্থী আবু বকর

এসময় তিনি আরো বলেন, শুধু তাই নয়, চৌগাছা উপজেলা প্রশাসনের ইউএনও এনামুল হক স্যারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। পাশাপাশি যশোরের গুড় ও পাটালির হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব রক্ষা করতে স্যারের সাথে বিস্তর আলোচনা করেছি। স্যার প্রশাসনিকভাবে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সবার ভালোবাসা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছি।"

আর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা? জানাতে চাইলে তিনি বলেন, "হ্যাঁ আছে। কৃষক সমিতি কিংবা ক্ষেতমজুর সমিতির মতো গাছিদের নিয়ে "যশোর গাছি কল্যাণ সমিতি" নামে একটা প্লাটফর্ম গঠন করার চিন্তা করছি। যাতে করে এই সমিতির মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাছিরা লাভবান হতে পার।"

আপনি বললেন আপনি তাদের কাছ থেকে গুড় পাটালি সংগ্রহ করেন। কিন্তু কীভাবে? তিনি জানালেন, "আসলে আপনি আমি আবেগ দিয়ে যতোই ঐতিহ্য রক্ষার চিন্তা করি কিন্তু গাছিরা চিন্তা করে তারা কতটুকু আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে যে কষ্ট সে অনুযায়ী গাছিরা দাম পাচ্ছেন না। আবার বড় কথা এর থেকে কম পরিশ্রমে কৃষিসহ অন্য পেশায় গাছিরা আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হচ্ছেন।

এজন্য গাছিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই জন্য চিন্তা করলাম আর্থিকভাবে ন্যায্য মূল্য না দিলে তারা তো এই পেশায় থাকবে না। সেজন্য আমি নিজেই AB Traditional Food নামে একটি অনলাইন প্লাটফর্ম দাঁড় করেছি। চৌগাছা ও ঝিকরগাছা উপজেলার প্রায় অর্ধশত গাছিদেরকে সংগঠিত করে আমার টিমের তত্ত্বাবধায়নে খাঁটি গুড় পাটালি তৈরি শুরু করে ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ করছি।

এতে একদিকে গাছিরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি যশোরের ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে যশোরের তারল্য অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। লোকাল কমিউনিটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।" কথা বলতে বলতে কখন যে সূর্য সেন হলের কাছে পৌঁছে গেলাম টের পেলাম না। হাতঘটিতে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় নয়টায় ছুঁই ছুঁই করছে। এবার বাসায় ফেরার তাড়া অনুভব করলাম। অবশেষে তাকে ধন্যবাদ দিয়েই আমি পা বাড়ালাম বাসার উদ্দেশ্যে।

ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ