Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

উচ্চ শিক্ষা নাকি শঙ্কা!

প্রকাশিত: ১৫ মার্চ ২০১৭, ২১:৫২

দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় চরম হতাশায় ভোগছে শিক্ষিত শ্রেণি। শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারের সন্তান। যে আশা নিয়ে তারা উচ্চ শিক্ষা নিয়েছিলেন সেই আশা হতাশায় রূপ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার সৌভাগ্য হলেও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলেনি। ফলে প্রতি নিয়ত সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে শিক্ষিত তরুণরা। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে চাকরী লাভের সহজ উপায় হচ্ছে ক্ষমতাশীল দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিচিতি, ঘুষ, লবিং কিংবা বিশেষ মহলের আর্শীবাদ প্রাপ্তি। এসব কোনোটাই না থাকলে চাকরী পাওয়ার দৌড়ে আপনার অবস্থান হবে পিছনে থেকে ১..২...৩.। হ্যাঁ মেধা দিয়ে যে একেবারে চাকরী হচ্ছে না তা বলছি না কিন্তু তা সংখ্যায় খুবি নগন্য। ফলে বেকারত্বের কারণে বিশাল শিক্ষিত তরুণ সমাজের চোখে অনিশ্চিত জীবনের দুঃস্বপ্ন। যদিওবা এদের শিক্ষা গ্রহণের প্রাককালে অনেক স্বপ্ন ছিল, জীবনের লক্ষ্য ছিল কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় তা ধূসর হয়ে গেছে।
আমাদের সামাজিক অবস্থা এমন যে একজন শিক্ষিত তরুণ চাইলেও তার ক্যারিয়ারকে নিজের মত সাজাতে পারে না কারণ দেশের প্রেক্ষাপটে মেধা বা যোগ্যতা দিয়ে যোগ্য স্থানে যাওয়া খুবই দূরহ ব্যাপার। সুইপার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা বিসিএস ক্যাডার সব নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির এক জমজমাট আসর। লবিং বা লিঙ্ক ছাড়া চাকরীর প্রত্যাশা করাটা কতটা বোকামী যারা এর ফল ভোগ করছেন তারাই বুঝেন। এক সময় মেধাবীরাই নিজেদের যোগ্যতা বলে কাঙ্খিত চাকরী পেতো কিন্তু বর্তমানে চাকরী বাজারে মেধা বা যোগ্যতা কোনোটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয় বরং রাজনৈতিক প্রভাব, মামার জোর কিংবা মোটা অংকের টাকা এসব নিয়ামক চাকরী লাভের পূর্ব শর্ত। কোনোটাই না থাকলে দৌড়াবেন তবে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন কিনা অনিশ্চিত। সুতরাং ডিগ্রি থাকলে চাকরীর নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে এমন চিন্তা করা বর্তমান বাস্তবতায় আষাঢে গল্পের মত। দুর্নীতিকে পুঁিজ করে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাই সুযোগ পাচ্ছে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে। পরবর্তীতে এই দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরাই নিয়ন্ত্রণ করে নিয়োগ বাণিজ্য আর অনুপ্রাণিত করে সেই চিরচেনা পথে। রক্তে যখন দুর্নীতি মিশে যায় তখন মেধা বা যোগ্যতা কোনো কাজে আসে না। সামাজিক এমন অবক্ষয়ের মূল কারণ নৈতিকতাহীন শিক্ষা। প্রতি বছর দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরীর বাজারে প্রবেশ করে কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় অধিকাংশই ডিগ্রিধারীকে খালি হাতে চরম হতাশা নিয়ে নিজ গৃহে ফিরতে হয়। তাহলে উচ্চ শিক্ষা বর্তমান প্রজন্মকে কি দিচ্ছে আশা নাকি শঙ্কা? শিক্ষাই জাতির মেরুদ-- যে বাক্য পড়ে আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই শিক্ষার মেরুদ- কোথায়? সত্যি যদি মেরুদ- থাকতো তবে আমরা সোজা হয়ে দাড়াঁতে পারতাম। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এর মিল কোথায়! ফলে শিক্ষাই শঙ্কিত জাতি!
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকের বেশি বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। সনদ অনুযায়ী চাকরি মিলছে না। এ কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। এ সংখ্যা বর্তমানে আরও বেড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে (২০১৬ সালে প্রকাশিত) , ২০১৫ সালে জাতীয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার লাখ ৫৫ হাজার ১৮৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করেছে। আর ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছে ৬১ হাজার ৪৮২ জন। সেই হিসাবে ২০১৫ সালে মোট স্নাতক পাস করেছে পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৬ জন। তবে ওই বছরে সরকারি কর্ম কমিশনসহ (পিএসসি) অন্য সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার কর্মী। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং বিভিন্ন ব্যাংকসহ বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মীর সংখ্যা দুই লাখের বেশি হবে না। ফলে পাস করা বাকি তিন লাখ স্নাতকই বেকার রয়ে গেছে। প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন, অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্ক, আইপিএনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর প্রায় ২৭ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসে। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাজ পায় মাত্র ২ লাখ মানুষ। ফলে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার থাকছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৫ অনুযায়ী, গেল দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে মাত্র ৩ লাখ মানুষ চাকরি বা কাজ পেয়েছেন। এর ফলে প্রতি বছর বেকার হচ্ছে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ। সেই হিসাবে দুই বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৬ সালের প্রতিবেদনের তথ্যমতে , ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার কমেছে। পরের তিন বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বেই শ্রমবাজার সংকুচিত হবে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান কমেছে ৪.২ শতাংশ হারে। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কমবে ৪ শতাংশ হারে।

২০১৫ সালে প্রকাশিত আইএলওর আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বেকারত্ব বাড়ছে বিশের¦ এমন ২০টি দেশের তালিকায় ১২ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। আইএলওর মতে, বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির বর্তমান হার ৩.৭ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে তা বেড়ে দ্বিগুণ হবে।
সব চেয়ে দুঃখের বিষয়- যে দেশে একজন রিক্সা চালক বা দিনমজুরের মাসিক আয় যেখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অনেককে মাত্র ছয় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরী করতে হয়। সার্বিক চিত্র দেখে মনে হচ্ছে ডিগ্রি নেওয়াটা তাদের জন্য অভিশাপ । চাকরীর পিছনে ছুটটে গিয়ে অনেক শিক্ষিত তরুণ জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকুই হারিয়েছেন এমন নজির কম নয়। আবার এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে চাকরী দেওয়ার নাম করে ব্যাংক ড্রাফট এর ব্যবসা করছে, আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চাকরী প্রার্থীদের থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মিডিয়াতে এমন প্রতারণার খবর হর হামিশায় ছাপা হচ্ছে যা তদারকির করার মত সময় সুযোগ সংশ্লিষ্টদের নেই ফলে এসব কর্মকা- দেদারছে চলছে। সব মিলে শিক্ষিত শ্রেণির অবস্থা লেজে গোবরে। তাই শিক্ষাটা এখন শঙ্কার যেখানে প্রাপ্তির চেয়ে হতাশার ব্যাপ্তি বেশি।
প্রতি বছর নতুন নতুন গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে আর স্বপ্ন নিয়ে চাকরীর প্রত্যাশায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অংগ্রহণ করছে। তবে দুঃখের বিষয় এদের মধ্যে অধিকাংশই চাকরী না পেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝায় পরিণত হচ্ছে। শিক্ষিত এসব যুবকদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ নেই বললে চলে যদিওবা সরকার ঢাঁকঢোল বাজিয়ে বলছে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে কিন্তু বাস্তবতায় কথার সাথে কাজের মিল নেই বললে চলে। যারা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চাকরী পাচ্ছে না কিংবা পেলেও তা কাঙ্খিত নয় বরং টিকে থাকার অবলম্বন মাত্র। এমনিতে সরকারি ও প্রাইভেট চাকরির মধ্যে বৈষম্য দীর্ঘ দিনের পুরানো তারমধ্যে হঠাৎ করে বর্তমান সরকার সরকারি চাকরীজীবীদের বেতন ১০০% বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র অংশকে খুশী করে বিশাল অংশকে বৈষম্যের চরম শিখরে নিয়ে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত শিক্ষিত শ্রেণির হতাশায় আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা হয়েছে। তাই এখন সবার টার্গেট থাকবে যেকোনো উপায়ে একটি সরকারি চাকরী নিশ্চিত করা। উচ্চ শিক্ষা, ডিগ্রি সবি হলো সুতরাং এবার শঙ্কায় থাকুন একটি ভালো চাকরী জুটবেতো কপালে! ক্ষমতাসীন সরকারের ভাব দেখে মনে হবে মানুষের মাথাপিছু আয় সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে অথচ বাস্তবতা হলো দেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাকি ৯৫ শতাংশের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখন দেশের শিক্ষিত শ্রেণির সার্বিক চিত্র দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষা বা ডিগ্রি অর্জনটাই তাদের জীবন-ধারণের পথকে কঠিন করে দিয়েছে!
সরকার জনগোষ্ঠীর ১০০% শিক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষার মান, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এসব বিষয়ে নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। পরীক্ষায় পাশ দেখলে মনে হয় দেশে মেধাবীদের খনি পাওয়া গেেেছ। যে হারে জিপিএ-৫ পাওয়া শুরু হয়েছে আর কয়েক বছর পর জিপিএ-৫ ছাড়া কেউ পাশ করবে বলে মনে হয়না । তার মানে ১০০% জিপিএ-৫ নিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে এটা নিশ্চিত। দেশের অনেক স্কুলে এখন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে সায়েন্স পড়তে হলে গোল্ডেন এ+ পেতে হবে তা না হলে সায়েন্স পড়া যাবে না। এবার একটু ভাবুন যারা জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন এ+ পাবে না তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মেধা কি শুধু জিপিএ-৫ দিয়ে বিবেচ্য নাকি প্রায়োগিক মূল্যায়ন? তবে বাস্তবতায় সব পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও চাকরীর বাজারে জিপিএ-এফ পেয়ে হতাশায় দিনাতিপাত করছে অসংখ্যা শিক্ষিত যুবক-যুবতী তাহলে এই অর্জনে সরকারের গর্জন কতটুকু যৌক্তিক! সরকার মনে করছে পরীক্ষার পাশের হার বাড়িয়ে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে এটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে কিন্তু এ অর্জন যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অভিশাপ হবে তা বোধগম্য হচ্ছে না। আবার ডিগ্রি অর্জন হলেই যে জ্ঞান অর্জন হয়েছে এমন ভাবা ঠিক না কারণ আমাদের দেশে জ্ঞান অর্জিত না হলেও সনদ অজর্ন খুব সহজ কাজ।
দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে তবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে যতেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে গুণী শিক্ষাবিদদের। ইতোমধ্যে কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে যে শিক্ষার প্রায়োগিক কোনো ভিত্তি নেই সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতি কতটুকু উপকৃত হবে! আমরা শুধু নামের শিক্ষিত হচ্ছি কিন্তু বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষা চলার পথকে আরও জঠিল করে দিচ্ছে। ফলে শিক্ষিত মানুষের কাছে এখন উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারটা শঙ্কায় রূপ নিয়েছে।
আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে শিক্ষার গুণগতমান রক্ষা করা।’বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হার সংখ্যাগতভাবে বাড়লেও গুণগতমানের বিচারে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা। সরকারকে শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত হয়েছে এ কথা শুধুমাত্র মুখে বললে চলবেনা তার বাস্তব রূপটিও বিবেচনায় আনতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেধাবী হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যে মেধাবী আছে তা আমরা ভেবে দেখিনা। তাই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তাদের উচিৎ শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি, শহর কিংবা গ্রাম আলাদাভাবে বিচার না করে যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা। তাছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমযোপযোগী শিক্ষা অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বে কোন মানের শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে । বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুিনকায়ন জরুরি। যেমন-অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, দক্ষ শিক্ষক, গবেষণার সুযোগ, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিক প্রচলিত ভাষাগুলোতে দক্ষতা অর্জন এসব বিষয় মাথায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বাড়াতে হবে। শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সকল ক্ষেত্রে শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদ-। আর এ মেরুদ-ের গঠন শক্ত না হলে জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাড়াঁনোর যে প্রচেষ্টা তা সম্পূর্ণরূপে ব্যস্তে যাবে। যেনতেনভাবে শিক্ষার হার বাড়িয়ে শিক্ষিত জাতি দাবি করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে কিন্তু সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। আর এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে আমাদেরকে বিকল্প পন্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানিকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্বমানের শিক্ষা ছাড়া অন্যদেশে গিয়ে চাকরী পাওয়া একেবারে অসম্ভব। আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারে। বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিশ্বমানের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হোক। একটি দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যখন বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তখন সেই দেশের কাঙ্খিত উন্নয়নের পথে আর কোনো বাধা থাকেনা।
উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো দক্ষ জনশক্তি। বিশ্বমানের শিক্ষার সাথে দক্ষ জনশক্তির বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। আর কোনো দেশের জনগোষ্ঠী যখন বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তখন তারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। যাতে করে বিদেশ নির্ভরতা কমে আসে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে যেসব পেশাজীবীর চাহিদা রয়েছে সেভাবে দেশের জনগোষ্ঠীকে তৈরি করতে হবে। কারিগরী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এ পেশায় জনগণের সম্পৃক্তা বাড়াতে হবে। আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির বিশাল একটি অংশ বেকারত্বের অভিশাপের বোঝা মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করছে। এটা যেমন তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য হতাশার তেমনি দেশের জন্যও অভিশাপ। মূলত গতানুগতিক শিক্ষার জন্য তাদের এই দুরাবস্থা। আমাদের শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক রৈখিক অর্থাৎ পূর্ব পুরুষরা যেদিকে অগ্রসর হয়েছে আমরা সেদিকে অনুসরণ করি। নতুনত্বকে আমরা এড়িয়ে চলতে চাই। ফলে আমরা প্রতিযোগিতা বিশ্বে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছি। দেশে ও বিদেশে দক্ষ জনশক্তির বেশ কদর। যেকোন কাজে দক্ষ হতে পারলেই চাকরী পেতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না। এরপরও আমরা সবাই এক পথে ছুটছি যা একটি দেশের জন্য শুভ সংবাদ হতে পারেনা। সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী ব্যাংকার হতে হবে এমন ধারণা মোটেও গ্রহণযোহ্য নয়। দেশের জনগোষ্ঠী এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে প্রত্যেক পেশাতে দক্ষ লোকবল থাকে। দেশের অসংখ্যা প্রতিষ্ঠান তাদের কাঙ্খিত লোকবল পাচ্ছে না । ফলে এইসব প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। একটি দেশের কাঙ্খিত উন্নয়ন তখনি সম্ভব যখন বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিটি সেক্টরে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত্তি হলো দক্ষ জনশক্তি।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। উন্নত দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো তার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। ঠিক তেমনি উন্নত দেশের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বোঝা নয় সম্পদে পরিণত করবে। উচ্চ শিক্ষা-শঙ্কা নয় বরং জাতির মুল ভিত এ লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের শিক্ষিত সমাজই বিনির্মাণ করবে স্বপ্নের বাংলাদেশ যেখানে দুর্নীতি নয় মেধা ও সততার মূল্যায়ন হবে এটাই প্রত্যাশা করে জাতি।

মো. সাইদুল ইসলাম চৌধুরী
বিএ(অনার্স)এমএসএম, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, চবি
উপাচার্য মহোদয়ের একান্ত সচিব ও জনসংযোগ কর্মকর্তা
সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
Email-saidmunna07@gmail.com

 

ঢাকা, ১৫ মার্চ (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমএইচ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ