মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ : ‘আমি বিশ্ববিখ্যাত, সেলেব্রেটি, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক, হলিউড অভিনেতা। আমি প্রেম সম্রাট সেফায়েত উল্লাহ। কী, হিংসে হয়? আমার মতো হতে চাও?’
কথাগুলো নিশ্চয়ই পরিচিত লাগছে সবার কাছে। না লাগার কোন কারণ নেই! সেফাত উল্লাহ ওরফে সেফুদা নামের এক বিকৃতমনস্ক লোক বাংলাদেশের অনলাইনে রাজত্ব করছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। অনেকের কাছেই তিনি আইডল, কারো কারো কাছে আবার সৎ সাহসের প্রতিমূর্তি! অথচ অস্ট্রিয়া প্রবাসী এই লোকের একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে গালি, এবং এই একটা ব্যাপারেই বোধহয় তার অসীম প্রতিভা। ‘ম’ কিংবা ‘চ’ বর্গীয় শব্দ ছাড়া তিনি কথাই বলতে পারেন না, ফেসবুক লাইভে এসে যাকে তাকে গালাগালি করাটাই তার কাজ।
আরেকটা কাজ তিনি করেন, মদ্যপান। সেটাও আবার ফেসবুক লাইভে এসেই। ভিডিওতে যুবসমাজকে মদ খাওয়ার আদেশ বা অনুরোধ জানান তিনি। তার ‘মদ খা’ ডায়লগটা তো এখন তুমুল জনপ্রিয়! অনলাইনে হাজার হাজার, কিংবা লক্ষ লক্ষ ভক্ত তার, এসব মানুষ বিনোদনের জন্যেই হোক, কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, অন্ধের মতো সেফাত উল্লাহকে পছন্দ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেফাত উল্লাহ এখন বিশাল সেলিব্রেটি, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে সুপার ডুপার হিট! কিন্ত এই বিকৃতমনস্ক মানুষটার তো এমন খ্যাতি পাবার কথা ছিল না!
নিজেকে মুক্তমনা, কবি, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অভিনেতা ও জাতিসংঘের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেন লোকটা। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত এবং ধনী ব্যক্তি বলেও দাবী করেন এই সেফাত উল্লাহ। বাংলাদেশের জনগণকে অশিক্ষিত, গরিব, মুর্খ এবং ছোটলোক বলে সম্বোধন করেন তিনি। রাজনৈতিক নেতাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এই গালিগালাজের নাম তিনি দিয়েছেন ‘শব্দ বোমা’। লাইভে এসে বাংলাদেশের জনগণকে তিনি মদ খাওয়ার আহ্বান জানান। মদ না খেলে বাঙালি কখনও মানুষ হবে না বলেও মনে করেন তিনি!
সেফাত উল্লাহ নামের এই ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে যতটা জানা যায়, এই লোকের আদি নিবাস ছিল চাঁদপুরে। একসময় বামপন্থী রাজনীতির সাথে সংযোগ ছিলল তার, বর্তমান বয়স ৬৫-৭০ এর মধ্যে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে সেফাত উল্লাহর স্ত্রী বলেছেন,
“২৮ বছর আগে দেশ ছাড়েন সেফাত উল্লাহ। তারপর থেকেই পরিবার থেকে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পরিবারের দাবি, বর্তমানে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত। আর তার এমন কর্মকাণ্ডে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন বিব্রত। আত্মীয়-স্বজনের কাছে আমাদের মুখ নাই। কেমন লাগতেছে আমরা জানি। এখন এগুলো কি বন্ধ করার কোনো পথ নাই? ইউটিউব কি এগুলো কোনো প্রতিকার করতে পারে না? আর উনি তো সিজোফ্রেনিয়া রোগী।”
ফিরোজ আহমেদ নামের এক অস্ট্রিয়া প্রবাসী সাংবাদিক জানান, ভিয়েনায় বাংলাদেশ কমিউনিটির এক পারিবারিক বিবাদে জড়িয়ে আদালতের রায়ে দীর্ঘদিন জেল খেটেছিলেন সেফাত উল্লাহ। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর অস্ট্রিয়ার আইন অনুযায়ী সেখানে তার লিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট হবার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে। মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন। এসময় ব্যাপকভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন সেফাত উল্লাহ।
সেফাতউল্লায় মানসিক বিকারগ্রস্থ, দাবী করেছেন তার পরিবারের সদস্যরাই। সেটা কতটুকু সত্যি কতখানি মিথ্যা, আমরা জানিনা। তবে এদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই যে মানসিকভাবে অসুস্থ, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। নইলে বিকারগ্রস্থ এই লোকটার এই ধরণের কর্মকাণ্ড নিয়ে এমন হইচই হবার কথা ছিল না। সেফাত উল্লাহ এখন অনলাইনে ‘ন্যাশনাল আইকন’ হয়ে গেছেন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা একটা বাজে লোককে দিনের পর দিন মাথায় তুলে নাচছে আমাদের মধ্যে অনেকে।
কেউ কেউ বলবেন, এগুলো শুধুই বিনোদন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কি সুস্থ বিনোদনের অভাব পড়েছে যে সেফাত উল্লাহ’র মতো মানুষের কাছ থেকে বিনোদন পেতে হবে? তার গালিগালাজ শুনে কি এমন বিনোদন পাওয়া যায়? নারীদের নিয়ে এই লোক যেসব কটুক্তি করেন, সেগুলো শুনলেও তো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার কথা।
এসবে মজা পাবেন কারা? যারা সেফাত উল্লাহ’র মতো বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বাস করেন। কিন্ত সুযোগের অভাবে সেটার প্রকাশ ঘটাতে পারেন না, তারাই নিশ্চয়ই। সুস্থ-স্বাভাবিক কোন মানুষের তো সেফাত উল্লাহ’র এসব কুরূচিপূর্ণ কথাবার্তা শুনে ভালো লাগার বা হাসি পাবার কথা নয়।
অথচ একটা প্রজন্মের হাজার হাজার মানুষ তাকে আইডল মানছে, তার ডায়লগ দিয়ে ফেসবুক সয়লাব করে ফেলছে, ‘মদ খা’ নামের প্যারোডি গান বানাচ্ছে, সেফাত উল্লাহ’র ছবি প্রোফাইলে ঝুলিয়ে রাখছে। শুধু যে অশিক্ষিত লোকজনই সেফাত উল্লাহ’র প্রেমে মজে আছে এমনটা নয়, শিক্ষিত এবং বিবেকবান লোকজনও সমানে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন! প্রোফাইল পিকচারে ‘হিংসা হয়’ ডায়লগ জুড়ে দিয়ে অদ্ভুত এক আত্মগরিমায় ভুগছেন কেউ কেউ। এটাই অবাক হবার মতো ব্যাপার। এরকম একজন অসভ্য ফেমসিকার পারভার্টের ফ্যান হয়ে আমরা কি প্রমাণ করতে চাইছি?
ভিডিওতে যেসব কথাবার্তা সেফাত উল্লাহ বলেন, যেভাবে বলেন, সেগুলো কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা সেগুলো দেখছি, হা হা করে হাসছি, নিজেদের জীবনে সেগুলো অ্যাপ্লাই করারও চেষ্টা করছি। কিন্ত কেন? ‘ফলো’ যদি কাউকে করতেই হয়, সেফাত উল্লাহকে কেন ফলো করতে হবে? ভালো কাউকে কেন নয়? আমরাই একসময় হিরো আলমকে সুপারস্টার বানিয়েছিলাম, অপরাধীর মতো একটা সাধারণ গানকে ইউটিউবে হিট করে ফেলেছিলাম। সেগুলোও আমাদের কাছে বিনোদনই ছিল সেই সময়ে! তবুও হিরো আলম বা অপরাধী গানের মধ্যে নোংরামি জিনিসটার উপস্থিতি ছিল না, যেটা সেফাত উল্লাহ’র মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান। বিনোদনের খোঁজে নোংরামিতে গা ভাসাতে হবে কেন আমাদের? কেন মা* চু** টাইপের গালাগালিতে বিনোদন খুঁজতে হবে?
ফেসবুকে এখন ভাইরাল হওয়াটা খুব সহজ। দুটো গালি দিলেও আজকাল ভাইরাল হওয়া যায়, হিট হওয়া যায়, হাজার হাজার অন্ধ ভক্ত বানিয়ে ফেলা যায়, সেটা সেফাত উল্লাহ প্রমাণ করে দিয়েছে। অনেকেই এখন ‘সেফুদা’ বলতে অজ্ঞান।
তারা হয়তো জানেও না, কি অসুস্থ মানসিকতার মধ্যে তাদের বসবাস। এই মানুষগুলোর জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার। চিকিৎসা দরকার তাদেরও, যারা সেফাত উল্লাহ’র এমন বিকৃত কর্মকাণ্ডে বিনোদন খুঁজে পায়, যারা তাদের প্রিয় ‘সেফুদা’কে আইডল মনে করে!
[কার্টেসি : এগিয়ে চলো.কম]
ঢাকা, ২৭ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: