Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

‘বিসিএস’ ম্যানিয়া কেন, সমাজ বাস্তবতার নিরীক্ষে

প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০১৮, ২০:২৮

শামসুল আরেফিন: একজন দিগ্বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে লেখাটা শুরু করছি 'আমাকে একটি শিক্ষিত 'মা' দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত 'জাতি' উপহার দেব'।

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের ৪৭ বছরের পথচলা। ২৩-বছরের পাকিস্তানি শাসন আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তাই স্বাধীনতার পরেই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল অনেকগুলো। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষায় আমরা ছিলাম অনেক বেশী অনগ্রসর।

১৯৭১ সালের জরিপে দেখা যায়, তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এদেশে গড় স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ (আহমেদ, ২০০৩)। বর্তমান সময়ে চিত্রটা বেশ বদলে গেছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ৫৩.৪ শতাংশ নারী শিক্ষিত (২০১৬ সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক এবং অন্যান্য উৎস)।

শিক্ষিতের হার বদলালেও কিন্তু অনেক কিছুই বদলায়নি। যেমন- বদলায়নি শিক্ষার বাজারজাত উদ্দেশ্য। এদেশে 'নলেজ/এডুকেশন হ্যাজ বিকাম কমডিটি' (লিওটারড)। শিক্ষার এই কমডিফিকেশনের পেছনে বর্তমান বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি এদেশে নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্ধ-শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গিই অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করি। কেননা এসমস্ত পরিবারে সন্তানদের লেখাপড়া করানোর পেছনে বাবা মায়ের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে পূর্বেকার অর্থনৈতিক টানাপোড়ন থেকে মুক্তিলাভ।

এবার চলুন একটা ভিন্ন গল্প শুনি 'রাহুল, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা শিক্ষিত বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। রাহুলের মা অর্থনীতিতে স্নাতক। আর তাই রাহুলের নানার ইচ্ছে ছিল, মেয়েকে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট বানাবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার নানা মারা গেলেন।
অত:পর রাহুলের মায়ের বিয়ে হয়ে গেল, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন তার অধরাই থেকে গেল। অপরদিকে, রাহুলের বাবারও সংগ্রামী জীবন।

দশ বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। তখন থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। এরই মাঝে এসএসসি-তে ৪-টিতে লেটার নম্বর সহ ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম! সেখানেই লেখাপড়ার সাথে যতিচ্ছেদ ঘটে তার।

কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকেনা। মানুষ পুনশ্চ স্বপ্ন নির্মাণ করতে থাকে। রাহুল তাদের ভরসার স্থল হয়ে ওঠে। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে রাহুলকে তারা মানুষ করতে থাকে। রাহুলও তাদেরকে নিরাশ করেনা। স্কুল, কলেজ সর্বত্র সাফল্যের ছোঁয়া রেখে সে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই রাহুলকে সিজিপি-এ তোলা নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়। একসময় হতাশা ঘিরে ফেলে রাহুলকে।

এসময় তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে তার ফুফাতো ভাই ম্যাজিস্ট্রেট সামির। ভাইয়ের পরামর্শক্রমে বাজার থেকে সে গোটা বিশেক বই কিনে আনে। অত:পর বাবা মায়ের দেখিয়ে দেওয়া স্বপ্নের উপর ভর করে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করে। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় রোমান, তাজিন, আরব, সুফল সহ আরও কয়েকজনকে। সবার পারিবারিক জীবনের পাওয়া না পাওয়ার গল্পগুলোও যেন একই রকম।'

আচ্ছা বলুনতো, রাহুলের কি কোন স্বপ্ন ছিল? নাকি সে স্বপ্ন দেখতে জানতো না? রাহুলেরও স্বপ্ন ছিল। ছোটবেলা থেকেই ও চাইতো আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের মত মস্ত বড় বিজ্ঞানী হতে। চাইতো সমুদ্রের বুকে ভেলা ভাসিয়ে ডুব-সাঁতার খেলতে। কিন্তু জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কাছে তাকে বারবারই হার মানতে হয়েছে।

এভাবেই জীবনের প্রয়োজনে (আনাংকি) নিজের ভাল লাগা বা ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে (ইরোস/লিবিডো) বিসর্জন দিয়ে বাবা মায়ের কিংবা সমাজের দেখানো পথেই হাঁটতে হচ্ছে রাহুলদের।

এক: এদেশে ব্রিটিশরা শাসন করে গেছে প্রায় দু'শত বছর। তারও আগে এদেশ শাসন করেছে ফরাসি,পর্তুগীজ, ডাচ, তুর্কি, মোঘল, সেন এবং পালরা। আর তাই এদেশীয় (নেটিভ) হিসেবে আমাদের শোষিত হয়ে থাকার ইতিহাসও দীর্ঘ। সেকারণেই আমাদের মনোজগতে অন্যের হুকুম পালন করার মানসিকতা রয়ে গিয়েছে। রয়েছে ক্রমাগত 'জী হুজুর, আজ্ঞে হুজুর, ইয়েস স্যার' বলার অভ্যাস।

স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়েও এই জী হুজুরগিরি বহাল তবিয়তেই চলছে। আর তাই নব্য বাংলাদেশের অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির মাঠ, খেলার মাঠ কোন কিছুই মুক্ত নয় এই মানসিক দাসত্বের ধর্মশালা হতে। ফলে আমরা সহস্র আমলা পেয়েছি, পেয়েছি শ্রমিক, রাজনীতির মানুষ ও কবি। শুধু পাইনি একজন আইনস্টাইন, সত্যেন বোস, বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কিংবা একজন আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে।

দুই: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা নাকি আমেরিকান সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা, কিংবা চৈনিক সভ্যতা। অথচ সভ্যতার সূচনা হয়েছিল আমাদের এই ভারতবর্ষ এবং আশেপাশের ভৌগোলিক মানচিত্রকে ঘিরে। পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা, ইরাকে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী সভ্যতা (৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব)।

তাই তখন থেকেই একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত ছিল এদেশে, 'আমাদের গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ'। উইটফোগেলও আমাদের এই সভ্যতাকে বলেছিল, 'হাইড্রোলিক সোসাইটি'। অনেক সমাজতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ আমাদের 'স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজ' ছিল বলে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এত কিছু থাকা সত্ত্বেও আমাদের আজ এই রুগ্ন অবস্থা কেন?

যে সময়ে এই ভারতবর্ষের সম্পদ লুণ্ঠন করে ইউরোপিয়ানরা কলকারখানা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরী, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছে সেই সময়ে আমরা এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কিছুই প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমরা পয়সা ঢেলেছি বায়জিদের পিছনে, বায়স্কোপ দেখে, বিলেত যেয়ে, কল্কি টেনে।

ফলে এখন আমাদের গোলা আছে কিন্তু ধান নেই; পুকুর আছে কিন্তু মাছ নেই! অথবা পুকুর কিংবা মাছ দুটোর কোনটাই নেই। ফলে মার্ক্সের 'অর্থনৈতিক মুক্তি' আর স্পেন্সারের 'সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট' নীতিই আমাদের জীবনের একমাত্র ইথোস। ফলস্বরূপ আজ প্রকৃত জ্ঞান হয়েছে উপেক্ষিত, বিসিএসের বাজার তাই রমরমা!

তিন: এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিসিএস নির্ভরশীলতাকে আমাদের কাছে বেমানান বলে মনে হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমার কাছে এই বিসিএস ম্যানিয়াকে রেশনাল বলেই মনে হয়। বেবারের 'রেশনাল চয়েজ' এর জায়গা থেকে দেখলে, বর্তমান সময়ে এদেশে বিসিএস-এর চাইতে ভাল কোন কিছু আছে বলে আমরা দেখতে পাইনা।

এদেশে সর্বত্র বিসিএস-এর চাকরীকে যেভাবে প্রমোট করা হয়ে আসছে, সেইভাবে আর কোন সেক্টরকেই প্রমোট করা হয়ে আসছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা করার জন্য নেই তেমন কোন বরাদ্দ। যৎসামান্য যা আছে তা দিয়ে এই যুগে হয়তো এক কাপ চায়ের খরচ চলে, কিন্তু গবেষণার কথা চিন্তাও করা যায়না।

সেকারণেই এদেশে একটা ব্রীজ, সেতু কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে গেলে বিদেশী স্থাপত্য শৈলীদের দ্বারস্থ হতে হয়। সামান্য বুকের ব্যাথা চিকিৎসার জন্য যেতে হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে। এ সমস্ত কিছুই এদেশে বিসিএস-এর চাহিদাকে উসকে দিয়েছে।

সবশেষে, রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। জং ধরা, ঘুণ ধরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সৃজনশীল নামক অসৃজনশীল কাঠামো ব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হবে স্কুল কলেজের বাচ্চাদের। প্রত্যেক পাড়া ও মহল্লাতে অসংখ্য লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কারাগারে পাঠাতে হবে।

শিক্ষিত বেকারদের জন্য উন্নত বিশ্বের মত ততক্ষণ পর্যন্ত বেকার ভাতা দিতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুণগত পঠন পাঠন এবং পর্যাপ্ত গবেষণার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যোগ্যদের যোগ্যতম স্থানে বসাতে হবে। তবেই এদেশে একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব, সম্ভব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া।


শামসুল আরেফিন (রেহান)
লেকচারার
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ।


ঢাকা, ২৫ জুন (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ