মো: মোতাছিমুল করিম: মায়ের চোখে আর পানি আসে না। তিনি বিহবল। নির্বাক। লোক দেখলেই এক পলকে চেয়ে থাকেন। তবে প্রায়ই মুর্চা যান। তার দুচোখ বেয়ে কবল পানি পড়ে। কিছুই বলতে চান না। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলেন “তোরা এত্ত খারাপ” তোদের মনে মায়া দয়া নেই। তোরা কোন মায়ের পেট থেকে পরিসনি!! আরো কত কি!!
শাস্ত্রমতে শুনেছি খোদার আরশ নাকি কাঁপিয়ে দেয়। হ্যাঁ আমার বুকে কাঁপুনি দিয়েছিল একটি বাক্য। এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারি নিয়ে আমার কাধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল "তোমরা শিক্ষিতরা এত্ত খারাপ"
প্রিয় বন্ধু আবু ববকরের মাকে স্বান্ত্বনা দিতে গিয়ে যে কথাগুলো শুনেছিলাম সে কথাগুলো, তার মায়ের আহাজারি এখনও কানে বাজে। সুচারু সুঁইয়ের মত বুকে আঘাত করেছিল সেই আকাশ কাপানো ক্রন্দন। যেন আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল সেসময়।
হ্যাঁ বলছি সেই আবু বকর সিদ্দিকের ব্যাপারে। তিনি ছিলেন প্রাণচঞ্চল্য মিষ্টিভাষী নিরীহ প্রকৃতির একটা মানুষ। এই মানুষটার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবার খেয়েছি ভাগ করে। কাপড় পড়েছি ভাগ করে। একে অপরের সুখ আর দু:খের সব কথা শেয়ার করেছি অকপটে। একটুও কৃপনতা করিনি।
আমার রক্তের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মনে হতো আমার রক্তের ভাই। আমার আপন কেউ। আমি যেন আজও তার কথা আর মিষ্টি আচলন ভুলতে পারিনি।
কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। তাকে ধরে রাখতে পারিনি। হায়ানাদের কঠিন আঘাতে তার জীবন দিতে হলো। নোংরা রাজনীতির বলি খেলায় আমাদের এ মেধাবী বন্ধুটি আজ মৃত্যু পরবর্তী অন্য জগতের বাসিন্দা।
তাকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আর এই নির্মমতার শিকার হয়েছে প্রাচ্যের অন্যতম বিদ্যাপীঠ প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই।
বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাসে আন্দোলনের ভয়ে হত্যাকারীরা অস্ত্র হাতে নিয়ে সেদিন হত্যার পরেও কাম্পাসে পাহারা বসিয়েছিল। প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ মেধাবী বন্ধুটির জানাজার নামাজও পড়তে দেয়নি।
আমার আমার এ বন্ধুটির মা সেদিন আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন ''তোমরা এত্ত খারাপ জানলে আমি আমার কলিজার টুকরারে ডাহা শহর পাডাইতামনা। কোন ভাষা ছিলনা সেদিন। অসহায় এক মায়ের বুকফাটা কান্নার জবাব দেয়ার মত।
প্রিয় বন্ধুটি প্রচণ্ড আর্থিক অনটনের মধ্যেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল।
শত অভাব আর প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ভর্তি হয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। টিউশনি আর ভাইয়ের মুদি দোকানের অর্থে পড়াশোনার খরচ চালাত বকর।
কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ‘সন্ত্রাসের’ জাঁতাকলে থেমে গেছে তার জীবনের লড়াই। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয় তাকে।
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে স্যার এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আবু বকর। টানা দুই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
শহীদ আবু বকরের মৃত্যুর ৮ বছর পার হলেও বিচার হয়নি অপরাধীদের। আর এ বিচার হবেও না কোনদিন সে বন্দোবস্ত ও পাকাপোক্ত হয়েছে গত বছরের ৭ মে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।
ইতিহাসের সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতার প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছে। আবু বকরের পিতা মাতার অগোচরেই গোপনে শহীদ আবু বকর হত্যা মামলার রায় হয়ে গেছে। কিন্তু এ রায় সম্পর্কে আবু বকরের বাবা-মা ও বাদীকে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি এ রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
বিচার যে হবে না তা আগে থেকেই স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছিল। বকরকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ ও ছাত্রলীগের প্রতি শুরু থেকেই পক্ষপাত করে আসছিল সংশ্লিস্টরা। ফলে হত্যার কারণ সম্পর্কে অস্পষ্ট কথা বলা, মামলার তদন্তে গড়িমসি ও গাফেলতি করার নানা ব্যাপার আমরা দেখছিলাম।
এ মামলার আসামিরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছিল জামিনে থাকা কয়েকজন।
২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে ছাত্রলীগের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুককে প্রধান আসামি করে ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হলেও এ ঘটনার এখনও সুষ্ঠু বিচার হয়নি।
মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- এনামুল হক, মনসুর আহমেদ রনি, আবু জাফর মো. সালাম, মফিদুল ইসলাম খান, রকিব উদ্দিন, মেহেদী হাসান ও তৌহিদুল খান তুষার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসামিদের অধিকাংশই মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ১০ ছাত্রকে নামমাত্র সাময়িক বহিষ্কার করে পরে আবার বহাল তবিয়তেই তাদেরকে পাশ করিয়ে বিদায় দিয়েছে।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামের দিনমজুর রুস্তম আলী ও রাবেয়া খাতুনের সন্তান আবু বকর। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারে প্রথমস্থান লাভকারী ছাত্র। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে।
কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়ায়নি সে। তারপরও রাজনীতির বলি তাকে হতে হয়েছে। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে চেয়েছিলেন আবু বকর।
আবু বকরের বড় ভাই আব্বাস আলী জানান, এখন আর কী বলার আছে? ভাই তো গেল। শত কথা বলেও তো তাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। ভাইকে পড়তে পাঠিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের আশা-ভরসার প্রধান স্তম্ভ ছিল সে। কিন্তু লেজুরভিত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির কলুষতা তাকে চিরতরে শেষ করে দিল।
স্বঘোষিত এই সভ্য সমাজ যে আসলেই অসভ্য আবু বকরের এই হত্যাই তার জ্বলন্ত প্রমান। মেধাবী এই বন্ধুটির পাশে থাকলেও তার হত্যাকারীদের বিচারটুকু আজ অবধি নিশ্চিত না করতে পারায় নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হয়।
আবু বকরের বাবা রুস্তম আলী এখনও তা মনে নিতে পারছেন না। শুধু বলেন, কোনোভাবে বেঁচে আছি। জানাযা শেষে কোন স্বান্ত্বনার ভাষা খোজে না পেয়ে বন্ধুরা আমাকে সামনে ঠেলে দিয়েছিল।
মা রাবেয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজেই হাউমাউ করে কেঁদে বলেছিলাম, আপনার এক বকরকে হারিয়ে দেখুন আপনি কত বকর পেয়েছেন। সেটা যে মিথ্যা স্বান্ত্বনা ছিল তা আমিও বুঝেছিলাম উনিও বুঝে বলেছিলেন, "আজ আমার বকরের লাশ নিয়ে তোমরা সবাই এসেছো, জানি আর কোনদিন আসবে না।"
হ্যাঁ আর কোনদিন এভাবে আমাদের যাওয়া হয়নি, হয়তো হবেও না। আমরা বিবেক বিবর্জিত পশু হয়ে গেছিতো তাই!
ওহে কর্তা কর্ত্রী তথা হোমড়া চোমড়া গণ, যদি ভেবে থাকুন মানুষের লাশের উপর ব্যক্তিগত সফলতার বুনিয়াদ গড়বেন ! তবে মনে রাখবেন এক সন্তান হারানো মায়ের বুকফাটা আহাজারি আর কান্নার পানির জবাব প্রত্যেককেই দিতে হবে। সে ভাবনা যেন থাকে, যদি পর জনমে বিশ্বাসীদের তালিকায় নিজেকে ভাবুন। আর অবিশ্বাসীদের তালিকায় থাকলে চালিয়ে যান যত পারেন তত দালালি আর তেলবাজি।
মাথায় রাখবেন, সন্তান সকলেরই আছে! স্রষ্টার সৃষ্টি বিচারে না জানি এ বিচারহীনতা আর অরারাজকতার শিকার আপনাদের কার সন্তান হয়! দোয়া করি এমন যেন না হয়।
ঢাকা, ০৩ ফেব্রুয়ারি (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: