Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

মহাসিন্ধুর ওপারে বাতিঘর

প্রকাশিত: ১৭ আগষ্ট ২০১৮, ২৩:৪৩

লাইভ প্রতিবেদক: গোলাম সারওয়ার। দেশবরেণ্য সাংবাদিক, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি। প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান। তিনি মহাসিন্ধুর ওপারে ঠাঁই নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সংবাদপত্র ইতিহাসে চিরস্মরণীয়দের সারিতে নিশ্চিতভাবে অন্তর্ভুক্ত হলেন। পাঁচ দশকের বেশি সময়জুড়ে নিরলস শ্রম, কঠোর অভিনিবেশ, অসামান্য পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে জাতির পথনির্দেশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করার ক্ষেত্রে তিনি অক্ষয় বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেন। কমপক্ষে চার প্রজন্মের সাংবাদিকের বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক এই ব্যক্তিত্ব স্বীয় কর্ম ও কীর্তির ধারাবাহিকতায় মহাসিন্ধুর ওপার থেকে অবিনশ্বর আলো বিতরণ করে যাবেন বলে দেশের সংবাদপত্র বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনে কর্মরত সব সহকর্মী মনে করেন।

যে কোনো বয়সী সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন 'প্রিয় সারওয়ার ভাই'। আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে তার হৃদয়ের সমুদ্রসম উদারদার স্পর্শ যারা পেয়েছেন, সমকালসহ দেশের প্রায় সবক'টি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও অনলাইনের সাংবাদিকরা- সবাই তার মৃত্যু সংবাদে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন। অনেকেই ছুটে আসেন সমকাল কার্যালয়ে। সমকালসহ বিভিন্ন পত্রিকার সব বয়সী সাংবাদিকের শোকস্তব্ধ মুখ আর কান্নাভেজা চোখ জানিয়ে দিচ্ছিল- তাদের মাথার ওপর থেকে বিরাট এক ভালোবাসার ছায়া মর্ত্যভূমি ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের সব প্রেস ক্লাব- দেশের যশস্বী সম্পাদক থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের তৃণমূল সাংবাদিক- সবাই তাদের প্রিয় 'সারওয়ার ভাই'য়ের অনন্তযাত্রায় শোকস্তব্ধ, আবেগবিহ্বল। ৭৫ বছর বয়সী গোলাম সারওয়ার মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়েসহ অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। গতকাল সোমবার দুপুরের পর থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন গোলাম সারওয়ারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বিকেল ৫টায় লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় তাকে। তখন চিকিৎসকরা তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছিলেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে।

সিঙ্গাপুরে গোলাম সারওয়ারের শেষ শয্যাপাশে ছিলেন তার স্ত্রী সালেহা সারওয়ার, দুই ছেলে গোলাম শাহরিয়ার রঞ্জন ও গোলাম সাব্বির অঞ্জন, কন্যা সুষমা নাইম রত্না, জামাতা মিয়া নাইম হাবিব এবং সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম। গোলাম সারওয়ার হৃদরোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৩ আগস্ট মধ্যরাতে সমকাল সম্পাদককে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। পর দিন সকালে তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।

বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন : বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে গোলাম সারওয়ার উজ্জ্বল এক নাম। মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার এ মানুষটি আমাদের সাংবাদিকতা জগতের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার শুরু থেকে একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এই পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বার্তা বিভাগে গোলাম সারওয়ারের সৃজনশীলতা, সংবাদবোধ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এদেশের সংবাদমাধ্যম জগতে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাকে দীর্ঘ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি একাধারে সৃজনশীল ও পেশাদার সাংবাদিকতায় অতুলনীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

পূর্বাণীতে তারই সম্পাদনায় এদেশে প্রথম ম্যাগাজিন আকারে বৃহদায়তনের ঈদসংখ্যা প্রকাশের রীতি শুরু হয়। তার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক হিসেবে পূর্বাণী অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসব কৃতিত্বের ধারাবাহিকতায় তিনি দেশের দুটি সেরা দৈনিক 'যুগান্তর' ও 'সমকাল'-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক এবং এর ছয় বছর পর ২০০৫ সালে আরেকটি নতুন দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুচারুভাবে পালন করে যান সে দায়িত্ব। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, ক্ষুরধার মেধা ও অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা পত্রিকা দুটিকে দ্রুততম সময়ে পাঠকপ্রিয় করে তোলে।

মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার কারণে গোলাম সারওয়ারকে অনেকেই 'সাংবাদিকদের শিক্ষক' হিসেবে অভিহিত করেন। তার হাতে গড়া অন্তত পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তার হাতে সরাসরি কাজ শেখা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বর্তমানে দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমের সম্পাদক বা প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা অনেকেই গর্বভরে নিজেদের পেশার শিক্ষক হিসেবে গোলাম সারওয়ারের অবদানের কথা উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের বিকাশ ও ক্রমপরিণতির ইতিহাসে গোলাম সারওয়ারের নাম অতিগুরুত্ব ও স্পষ্টতার সঙ্গে উচ্চারিত হবে বারবার। শৌখিন, কুটিরশিল্পসদৃশ সংবাদপত্রের ক্ষীণ বলয় থেকে বৃহৎ কলেবরের সংবাদপত্রের অভিযাত্রার অন্যতম সফল পথিকৃৎ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তিনিই প্রথম এদেশে প্রতিদিন রঙিন খেলার পাতা, বিনোদন পাতা, নানা স্বাদের গুচ্ছ গুচ্ছ ফিচার প্রকাশ করার রীতি প্রবর্তন করে দৈনিক পত্রিকার চেনা অবয়বকে পাল্টে দিয়ে একটি দৈনিককে পরিবারের সব সদস্যের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনাকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করেন। সংবাদকে তার উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ট্রিটমেন্টে প্রকাশ করায় তার সমতুল্য কোনো সম্পাদক এদেশে নেই- এটি অপরাপর সম্পাদকের ভাষ্যেই বহুবার জানা গেছে। গোলাম সারওয়ার এদেশের সংবাদপত্রের সাফল্য ও পেশাদারিত্বের প্রতীক।

তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ার এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা ও মা মরহুম সিতারা বেগম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে তার সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদে চাকরিরত ছিলেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিজ এলাকা বানারীপাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার পরপরই ১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে সিনিয়র সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে প্রধান সহসম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

সৃজনশীল সাহিত্যে গোলাম সারওয়ারের অকৃত্রিম আগ্রহ ও উদ্যোগ তার সৃষ্টিশীলতা ও প্রাণময়তার আরেক ক্ষেত্র। দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যকে তিনি মানে ও মর্যাদায় স্বতন্ত্র করেছেন। তার গদ্য স্বাদু-অনায়াস দক্ষতায় তিনি রাজনীতির বক্র বিষয়াদির সঙ্গে সমকালীন বাস্তবতা ও ধ্রুপদী সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেন। তিনি দক্ষ ছড়াকার; ষাটের দশকে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন।

সত্তরের দশকেও ছড়ায় সচল রেখেছিলেন নিজের কলম। 'রঙিন বেলুন' নামে শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ছড়ার বইটি তার ছড়া সৃষ্টির উজ্জ্বল নিদর্শন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতে একসময় তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ। তার লেখা বেশ কয়েকটি গান আজও শ্রোতাহৃদয়ে শিহরণ জাগায়। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে 'সম্পাদকের জবানবন্দি', 'অমিয় গরল', 'আমার যত কথা', 'স্বপ্ন বেঁচে থাক' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকতায় জীবনব্যাপী অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

তিনি চিরকালের বাতিঘর :'দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে শুরু থেকেই গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী ছিলেন। একজন পেশাদার সাংবাদিক যে কতটা নিষ্ঠ সাহিত্যপ্রেমী হতে পারেন, সারওয়ার তার বড় উদাহরণ। দেশের মস্তিস্ক সুস্থ না থাকলে কোনোভাবেই সে দেশের বিকাশ সম্ভব নয়, জানতেন বলেই সারওয়ারের হাতে বরাবর সাহিত্য, শিল্প ও রাজনীতি- এ তিনই নিরাপদ ছিল। তিনি সত্যিকারের বাতিঘরের মতো ছিলেন, আমাদের কাছে; থাকবেনও চিরকাল।'

সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে ছিল তার হৃদয়ের যোগ। একসময় পূর্বাণী পত্রিকা সম্পাদন করে তিনি চমক সৃষ্টি করেন। তার মতো হৃদয়বান ও মেধাবী মানুষের মৃত্যু সংবাদপত্র জগতের জন্য বড় দুঃসংবাদ। আমি নিজে হারালাম আমার অকৃত্রিম এক স্বজন।' গায়ক জেমস বলেন, 'সারওয়ার ভাই সংবাদপত্রে নেতা ছিলেন। সকলে তাকে যেভাবে মান্য করে এগিয়ে যেত, তা আমার নিজের চোখে দেখা। তার ভেতরে গভীর এক শিল্পী বাস করত। সারওয়ার ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা।'

 


ঢাকা, ১৭ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ