Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী জামানা

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বার ২০১৬, ০১:৩০

 

 

লাইভ প্রতিবেদক: যখন ডনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকাকে ফের মহান বানানো’র পণ করলেন, তিনি তখন মূলত আশির দশকে রনাল্ড রিগ্যানের কথাবার্তারই পুনরাবৃত্তি করছিলেন। (জিমি) কার্টারের শাসনামলের ব্যর্থতার পর ভোটাররা তখন নবজাগরণ খুঁজছিল। এ মাসে তারা ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছে, কারণ রিগ্যানের মতো তিনিও এমন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা কিনা ‘ঐতিহাসিক’ আর ‘এক জীবনে একবারই’ আসে। কিন্তু পার্থক্যও আছে।

ভোটের প্রাক্বালে রিগ্যান আমেরিকাকে ‘পাহাড়ের বুকে উজ্জ্বল এক নগরী’ রূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। দুনিয়াকে নিরাপদ রাখতে আমেরিকা কী অবদান রাখতে পারে, তার বিবরণ দেওয়া ছাড়াও তিনি এমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যে দেশ ‘অন্তর্মুখী হবে না, বহির্মুখী হবে অন্যদের প্রতি ছুটে যাবে’। অপরদিকে ট্রাম্প আমেরিকাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার শপথ নিয়েছেন। পরজীবী দুনিয়ার কাছ থেকে মর্যাদা দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘এ দেশ আর দেশের মানুষকে বিশ্বায়নের মিথ্যার বেসাতির কাছে আত্মসমর্পন করতে দেব না।’ রিগ্যানের আমেরিকা ছিল আশাবাদী। আর ট্রাম্পের আমেরিকা অগ্নিশর্মা।

নব জাতীয়তাবাদে স্বাগতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো, বৃহৎ ও উদীয়মান শক্তিগুলো একসঙ্গে নানা প্রকারের উগ্র দেশপ্রেমের দাসে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্পের মতো, রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের মতো দেশের নেতারা এক হতাশাবাদী নীতি ধারণ করেছেন যে পররাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো হলো অনেকটা ‘জিরো-সাম খেলা’র মতো। যেখানে বৈশ্বিক স্বার্থ আর জাতীয় স্বার্থ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

এই বড় পরিবর্তন দুনিয়াকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট এমনই এক চিত্রের অবতারণা করেছে তাদের ‘দ্য নিউ ন্যাশনালিজম’ নিবন্ধে।
এতে বলা হয়েছে, জাতীয়তাবাদ একটি পিচ্ছিল ধারণা। এ কারণেই রাজনীতিবিদরা একে সহজেই অপব্যাবহার করতে পারেন। এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এর দরুন মানুষ একটি সাধারণ মূল্যবোধকে ঘিরে এমন সব অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয় যা কারও একার পক্ষে সম্ভবপর নয়। এই ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ মৈত্রীসূচক ও দূরদর্শী। যেমন, পিস কর্পসের জাতীয়তাবাদ, কানাডার অংশগ্রহণমূলক দেশপ্রেম অথবা ২০০৬ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নিজ দলের প্রতি জার্মানির সমর্থন।

নাগরিক জাতীয়তাবাদ মুক্তি ও সমতার মতো বৈশ্বিক মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট। এর সঙ্গে ‘জাতিগত জাতীয়তাবাদে’র তফাৎ রয়েছে। জাতিগত জাতীয়তাবাদ ‘জিরো-সাম’, আক্রমণাত্মক আর পড়ে থাকে অতীতের স্মৃতি নিয়ে। বর্ণ ও ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে এ জাতীয়তাবাদ জাতিকে আলাদা করে দেয়। বিংশ শতাব্দির প্রথম অর্ধে, এ জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

ট্রাম্পের লোকরঞ্জনবাদিতা নাগরিক জাতীয়তাবাদের প্রতি চপেটাঘাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তার পূর্বসুরীদের দেশপ্রেম নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করেনি। অথচ, তাদের প্রত্যেকেই আমেরিকার সার্বজনীন মূল্যবোধকে সমর্থন করেছিলেন, একে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সীমান্তের বাইরে। তবে এক ধরণের ব্যাতিক্রম থাকার অনুভূতি পূর্বের প্রেসিডেন্টদেরকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ও ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল’ অব সি (ইউএনসিএলওএস)-এ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত রেখেছিল।

তা সত্ত্বেও, আমেরিকা নিয়মভিত্তিক ক্ষমতার বিন্যাস সমর্থন করেছিল। এমন সব বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমেরিকা সমর্থন দিয়েছিল যা এ বিশ্বকে রক্ষা করেছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ও বিশ্বকে অধিকতর নিরাপদ রেখেছে, আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এ অঙ্গিকারকে দুর্বল করে দেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের।

এই জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দুনিয়ার অন্যত্রও শক্তিশালী হচ্ছে। রাশিয়ায় পুতিন বিশ্বজনীন উদার মূল্যবোধকে পরিহার করে গেছেন। ধারণ করেছেন পুতিন ঐতিহ্য আর রক্ষণশীল খ্রিষ্টবাদের রাশিয়ান মিশ্রণকে। তুরস্কে রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

কুর্দি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা বাদ দিয়েছেন। তিনি বরং কর্কশ ইসলামি জাতীয়বাদের পক্ষে। খুব দ্রুতই বহির্বিশ্বের অপমান আর হুমকি খুঁজে বের করে এই জাতীয়তাবাদ। ভারতে নরেন্দ্র মোদি বাইরে বেশ ফিটফাট, আধুনিকায়নমুখী। কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে উগ্রপন্থী জাতি-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। এ গোষ্ঠীগুলো প্রচার করে উগ্র দেশপ্রেম আর অসহিষ্ণুতা।

এদিকে চীনা জাতীয়তাবাদ এতটা ক্ষুদ্ধ আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে যে খোদ শাসক দল একে বাগে আনতে হাঁসফাঁস করছে। সত্য যে, এ দেশটি অবাধ বাজার ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরশীল, অনেক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে মেনে নিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠও হতে চায়। কিন্তু নব্বই দশক পরবর্তী স্কুলশিক্ষার্থীরা ‘দেশপ্রেমী’ শিক্ষার দৈনিক ডোজ পেয়েছে। এবং, ঠিকভাবে চীনা হিসেবে চিহ্নিত হতে চাইলে আপনাকে কার্যত হান জনগোষ্ঠীর অংশ হতে হবে। বাকি সবাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

এই জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ উন্নতি করেছে বটে। কিন্তু ‘অজাতীয়তাবাদে’র যে বিশাল পরীক্ষা বিশ্ব চালিয়েছিল তা ভেঙ্গে পড়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্রষ্টা যারা, তারা বিশ্বাস করতেন জাতীয়তাবাদ হয় নির্জীব হয়ে যাবে বা মারা যাবে। কারণ, এর কারণেই ইউরোপকে দুইটি ধ্বংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধে যেতে হয়েছে।

স্রষ্টাদের বিশ্বাস ছিল, ইইউ জাতীয়তা ভিত্তিক শত্রুতাকে অতিক্রম করে যাবে। এতে থাকবে আপনার একাধিক পরিচয়। আপনি একাধারে ক্যাথলিক, আলসাতিয়ান, ফ্রেন্স ও ইউরোপিয়ান সবই হতে পারবেন। কিন্তু, ইইউর বড় অংশগুলোতে এমনটা আর হয়ে উঠেনি।

বৃটিশরা ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছে। পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতো সাবেক কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতা চলে গেছে বিদেশী-বিদ্বেষী উগ্র জাতীয়বাদীদের হাতে। ছোট কিন্তু বর্ধিষ্ণু হুমকি আছে যে ফ্রান্সও ইইউ ত্যাগ করতে পারে, অর্থাৎ ধ্বংস করে দিতে পারে ইইউকে।

সর্বশেষ আমেরিকা অন্তর্মুখী হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। এর ফলাফল হয়েছিল বিপজ্জনক। ট্রাম্পের নব জাতীয়তাবাদকে ভয় পেতে হলে আপনার ভয়াবহ কিছু অনুমান করার দরকার নেই। ঘরে এটি অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করছে, ফলে সংখ্যালঘুদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও আনুগত্য নিয়ে সন্দেহের বীজ বুনছে। এটি কোন দুর্ঘটনা নয় যে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো আমেরিকান রাজনীতির উপশিরায় ইহুদী-বিদ্বেষের অভিযোগের সংক্রমণ ঘটেছে।

বহির্বিশ্বে, অন্যান্য দেশ অন্তর্মুখী আমেরিকাকে দেখে অনেককিছু আঁচ করছে। ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যাগুলো সমাধান করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। এ সপ্তাহে আইসিসি’র বার্ষিক সম্মেলন তিন আফ্রিকান সদস্য রাষ্ট্রের পদত্যাগের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আঞ্চলিক অখ-তার দাবি ইউএনসিএলওএস’র সঙ্গে যাচ্ছে না। নিজের বাণিজ্যবাদী বাগাড়ম্বরের ক্ষুদ্র অংশও যদি ট্রাম্প বাস্তবায়িত করতে যান, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন শক্তি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।

যদি তিনি মনে করেন আমেরিকার মিত্ররা প্রাপ্ত নিরাপত্তার বিপরীতে যথাযথভাবে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে, তাহলে তাদের কাছ থেকে মুখ ফেরানোর হুমকি দিলেন তিনি। ফলাফলস্বরূপ, বিশেষ করে বৈশ্বিক নীতি দ্বারা সুরক্ষিত ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য, আরও কঠোর ও অস্থিতিশীল বিশ্বের অবতারণা ঘটবে।

ট্রাম্পের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে তার নীতি প্রকাশিত হবে অন্য দেশগুলোর ঈর্ষান্বিত জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে। সংযোগচ্যুত হওয়াটা আমেরিকাকে দুনিয়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে দেবে না। কিন্তু নব জাতীয়তাবাদের ফলে যে উত্তেজনা আর শত্রুতা জন্ম নেবে তার ঝুঁকিতে আমেরিকা পড়বে বেশি। বৈশ্বিক রাজনীতি এখন বিষাক্ত। ফলে আমেরিকা আরও দরিদ্র হয়ে উঠবে, মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়বে।

আর ট্রাম্প আটকা পড়বেন প্রতিহিংসা আর শত্রুতার ভয়াবহ এক দুষ্টচক্রের ফাঁদে। নিজের অশুভ উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করার জন্য সময় ফুরিয়ে যায়নি ট্রাম্পের। নিজের দেশ ও বিশ্বের জন্য হলেও তার দরকার জরুরিভিত্তিতে পূর্বসুরি প্রেসিডেন্টদের আলোকিত দেশপ্রেম পুনরায় ধারণ করা।
( দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন নাজমুল আহসান)

 

ঢাকা, ১৮ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এএসটি


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ