Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | মঙ্গলবার, ১৪ই মে ২০২৪, ৩১শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

যে কারণে সমাস বাংলা ব্যাকরণে (স্কুলপাঠ্য?) দরকার নেই

প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বার ২০১৭, ০৮:৪১

মামুন রশীদ : সমাস বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, বলা যায় অপ্রয়োজনীয় অধ্যায়ও। বাংলা ভাষা শিখতে বা বুঝতে সমাসের তেমন কোনো ভূমিকা নেই! সমাস পড়তে ছমাস লাগে—এই হলো স্কুলের ক্লাসে সমাসপাঠ শুরুর বচন। বাংলা ব্যাকরণকে জটিল, অজনপ্রিয়, ভীতিকর, মুখস্থমুখী করার জন্য যে কয়টি অধ্যায় রয়েছে তার মধ্যে, প্রচলিত সমাসব্যবস্থা সর্বাগ্রে। এই দাবি দিয়ে সমাস-অধ্যায়টিকে বর্জন করা হলে একদল খুশি হবেন, একদল অখুশি হবেন।

খুশি হবেন যারা, তারা মূলত পরীক্ষার্থী। সমাসের মাধ্যমে বাংলা ভাষা শেখা বা বোঝার বদলে এরা মুখস্থ ও শর্ট টেকনিক অবলম্বন করে থাকে। স্কুল-কলেজের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দও সমাজ শিক্ষাদান বলতে শর্ট টেকনিক শেয়ার আর মুখস্থ করার বুদ্ধি দেন।

অখুশি হবেন তারা, যারা মূলত বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণকে সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে দেখতে চান। সমাসবদ্ধ পদের প্রতি দুর্বল কবিরাও সমাস বর্জন করলে অখুশি হবেন। একই সঙ্গে গাইডবই প্রণেতা ও মুদ্রকরাও অখুশি হবেন- ব্যাকরণে সমাসের উদাহরণ যত বেশি, পৃষ্ঠা তত বেশি, দামও তত বেশি। সবচেয়ে বেশি অখুশি হবেন, স্কুল-কলেজের ব্যাকরণ পড়ানো শিক্ষকবৃন্দের একটি অংশ : যারা মনে করেন, জ্ঞান অপরিবর্তনযোগ্য, স্থির, স্ট্যাটিক। ব্যাকরণ নামের গাইডবই প্রণেতারাও অখুশি হবেন। আসলে সমাস বর্জন নয়, স্কুল-কলেজে বড় কলেবরে সমাসপঠনের বিরোধিতা করছি। সমাসপঠনের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে হাইপোথিসিস বলা যেতে পারে- এই লেখাকে।

২.
সহজ কথায়, সমাস মানে একপদীকরণ। একটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে ব্যাখ্যাযোগ্য ধারণা। ধারণাটিকে বড় করে প্রকাশ করার বদলে একপদে প্রকাশ করার পদ্ধতিই হলো সমাস। যেমন, নীলবসনা। যে নারীর বসন নীল/ নীল বসন যার—তাকেই বলা হচ্ছে নীলবসনা। বড় বাক্য না বলে একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে ফেললাম। সমাসের সুফল এই।

সমাসের প্রয়োজন কোথায়—উত্তর হলো ‘শব্দগঠন বুঝতে’। বাংলা শব্দ যত প্রকারে গঠিত হয়, তার একটি প্রকার সমাস। প্রচলিত ব্যাকরণ অনুসারে, ছাত্ররা মুখস্থ করে পাঁচ প্রকারে শব্দ গঠিত হয় : সন্ধি হয়ে, উপসর্গযোগে, প্রত্যয়যোগে, বিভক্তিযোগে ও সমাসের মাধ্যমে।

আমার প্রস্তাব হল, বাংলা ব্যাকরণের অপর চারটির চেয়ে সমাস জটিল, বিশৃঙ্খল, ব্যাখ্যাহীন। সমাস পাঠ করতে গিয়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়, যেগুলোর উত্তর বাংলা ব্যাকরণে নেই (সংস্কৃত ব্যাকরণে থাকতে পারে)।

ক. সমাস পড়তে গিয়ে পরপদ, পূর্বপদ, ব্যাসবাক্য, বিগ্রহবাক্য, সমস্তপদ কিছু পরিভাষার সম্মুখীন হন—যেসব পরিভাষা শিক্ষার্থীদের বয়স ও মানসিক পরিপক্কতার তুলনায় কঠিন। ব্যাসবাক্য মানে কী—তা শিক্ষক যেমন শেখান না, তেমনি ছাত্ররাও সাধারণ বুদ্ধিপ্রয়োগ করে ধারণা করতে পারে না, মুখস্থই অবলম্বন। সমাসের প্রকরণগুলোর অর্থও শিশু/কিশোর বয়সের বোধগম্য নয়। তৎপুরুষ কেন পুরুষ, অব্যয়ীভাব কেন ব্যয় করে না, কর্মধারয় অর্থ কী? কোন বাংলা ব্যাকরণে রয়েছে? শিশুরা সরল মনে প্রশ্ন করলে উত্তর কোথায় (প্রাগ্রসর পর্যায়ে নিশ্চয়ই রয়েছে। স্কুলপাঠ বইয়ে নেই)।

খ. সমাস পড়ার পদ্ধতিটি অযৌক্তিক। সিংহাসন শব্দটি শেখানো হয় মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস হিসেবে। কারণ, একে ব্যাখ্যা করলে নাকি পাওয়া যায়, সিংহ চিহ্নিত আসন। মাঝখানের পদ লোপ পায়, তাই মধ্যপদলোপী। সিংহাসন যে সিংহ চিহ্নিত আসন হবে এমন কথা নেই, সিংহের আসন বা রাজার আসন হিসেবে সিংহাসনকে ব্যাখ্যা করা যায়। সিংহাসন শব্দটিকে সন্ধিবদ্ধ (সিংহ+ আসন= সিংহাসন) পড়তে অসুবিধা কোথায়? যদি বিদ্যালয় (বিদ্যা চর্চার আলয় না হয়ে বিদ্যা+ আলয় হয়) সন্ধিযুক্ত হয়, তাহলে সিংহাসনকেও সন্ধিবদ্ধ বলতে বাধা কী? এরকম অসংখ্য সন্ধিবদ্ধ পদ সমাস অধ্যায়ে ব্যবহৃত হয়। দেবাসুর শব্দটি কী দেব ও অসুর হবে নাকি দেব+অসুর হবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ঠিক তেমনি সংগীত শব্দটি সন্ধি সাধিত না সমাসবদ্ধ- বিতর্ক আছে।

গ. বাংলা ভাষা সমাস অধ্যায়ে উচ্চারিত হয় এমন শতাধিক শব্দ রয়েছে যেগুলো ব্যাসবাক্য একাধিক হতে পারে। ব্যাসবাক্য একাধিক হওয়ার স্বাধীনতা নেই, যেহেতু স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ মনে করেন, বাংলা ব্যাকরণ আনুশাসনিক। বইয়ে যা লিখা, তাই লিখতে হবে, বিকল্প কিছু শুদ্ধ নয়—এমন ধারণার চল রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ওখানেই বিপদে পড়ে।

একাধিক ব্যাসবাক্য নিয়ে বিপদের উদারণ দিতে গিয়ে একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করছি- উড়ালসেতু। শব্দটি নিশ্চই সমাসনিষ্পন্ন। এর ব্যাসবাক্য হতে পারে, যে সেতু দিয়ে উড়াল দেয়ার মতো কাজ হয়, উড়ালের সেতু, যে সেতু উড়াল দিতে পারে ইত্যাদি।

এই বহু ব্যাসবাক্য হওয়ার সম্ভাবনা ‘সমস্তপদ দিয়ে ব্যাসবাক্য’ নির্ণয়ের প্রচলিত পদ্ধতিকে দুর্বল করে দেয়।

যেমন, চাঁদমুখ হতে পারে, চাঁদের মতো মুখ, তবে কি গুহামুখ গুহার মতো মুখ? নাকি গুহার মুখ?

ঘ. দ্বিগু সমাস মানে সমাহার থাকতে হবে। যেমন, চতুষ্পদী হল ‘চার পদের সমাহার’। অর্থ কী? গরু-ছাগল না টেবিল?

তাহলে, দশানন কি দশ আননের সমাহার, নাকি দশ আনন যার? প্রচলিত ব্যাকরণ বলে দ্বিতীয়টি ঠিক। কেন? দশভুজা ব্যক্তি বোঝায় কিন্তু দশভুজ হলেতো ব্যক্তি বোঝাবে না, তখন কী দ্বিগু হবে?

সাতসমুদ্রের তো সমাহার হয় না, যে অর্থে ত্রিমোহিণী জড়িয়ে আছে একই বিন্দুতে। সাতসমুদ্র কেন সমাহার দিয়ে দ্বিগু?

ঙ. অব্যয়ীভাব সমাসে উপ, গর প্রভৃতি অব্যয় বিশেষ্যের পূর্বে বসে অব্যয়ের অর্থ বিরাজ রাখে। ন জানা থেকে অজানা—নঞ তৎপুরুষ কেন?

চ. সবচেয়ে নড়বড়ে কর্মধারয় সমাস। সমাসটি নিজের সংজ্ঞাসহ উপমান উপমেয় বিষয়ে প্যাচানো ব্যাখ্যা দেয়া আছে প্রচলিত ব্যাকরণে।

সংজ্ঞা বলে, ‘যেখানে বিশেষণ বা বিশেষণভাবাপন্ন পদের সাথে বিশেষ্য বা বিশেষ্যভাবাপন্ন পদের সমাস হয় এবং পরপদের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় তাকে কর্মধারয় সমাস বলে’।

যেমন, নীলপদ্ম। নীলপদ্ম শব্দটিতে পদ্ম প্রাধান্য রয়েছে এমন ধারণা পেতে মাতৃভাষা বাংলা কিংবা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শিখছেন- এমন ব্যক্তিকে কেন কর্মধারয় সমাসের মুখোমুখি হতে হবে।

‘জজসাহেব’ শব্দটি কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ। এর ব্যাসবাক্য যিনি জজ তিনিই সাহেব! আর কেউ সাহেব না! ভদ্রমহিলা শব্দটি তাহলে হবে, যিনি ভদ্র তিনিই মহিলা!

সবচেয়ে বিপজ্জনক, রূপক কর্মধারয়। মনমাঝি হলো মন রূপ মাঝি। মনের মাঝি বললে অসুবিধা কোথায়।

ছ. প্রাদি সমাসের দরকার কী? যদি দরকার হয়, তাহলে উপসর্গযোগে শব্দ গঠনের অংশ ব্যাকরণে থাকার যৌক্তিকতা নেই!।

জ. দ্বন্দ্ব সমাস বলে, সব পদের প্রাধান্য থাকলে তবেই দ্বন্দ্ব। শিশুরা কী করে বুঝবে কোন পদের প্রাধান্য? তাল-তমাল শব্দে কোনটির প্রাধান্য রয়েছে? হাইফেন দিয়ে একপদীকরণ করা সমাসদর্শনের সঙ্গে যায় না!

ঝ. সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো বহুব্রীহি সমাসের সংজ্ঞা। যে সমাসে সমস্যমান পদগুলোর কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্যকোনো পদকে বোঝায় তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন, বহুব্রীহি (ধান) আছে যার=বহুব্রীহি। এখানে ‘বহু’ কিংবা ‘ব্রীহি’ কোনোটিরই অর্থের প্রাধান্য নেই, যার বহু ধান আছে এমন লোককে বোঝাচ্ছে। অবশ্যই নতুন তৈরি হওয়া পদের অর্থ আলাদা। সমস্যমান পদগুলোর অর্থ বহুব্রীহি সমাসের সমস্তপদে অবশ্যই রেয়েছে। আয়ত লোচন যার তাকে আয়তলোচনা বললে প্রথম দুটি পদের অর্থের সঙ্গতি আয়তলোচনায় রয়েছে। ঠিক তেমনি, মহাত্মা।

৩.
আসলে, এমন অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হবে। যার কোনোটির হয়তো ভিত্তি নেই। এমনও হতে পারে, কোনোটিরই ভিত্তি নেই। বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ অনেকের কাছে এমনি প্রণম্য যে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অপরাধ।

বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে তৈরি হয়েছে কিনা, সুনীতিকুমারের নীতিই বাংলা ব্যাকরণের নীতি- এমন জিজ্ঞাসা ও বিতর্কের সমাধান এখানে নয়। স্কুল জীবনে ছাত্রদের সমাস না পড়িয়ে উচ্চতর/প্রাগ্রসর পর্যায়ে পড়ানো উচিত। সম্ভব হলে সমাসকে পরিহার করেই পাঠক্রম করা যেতে পারে।

বাংলা ব্যাকরণ-ভীতি দূর হোক...


লেখক, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, বাংলা বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা, ২৬ সেপ্টেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ