Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

“বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানিঃ মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যক”

প্রকাশিত: ২৯ আগষ্ট ২০১৭, ২১:৩৭


মোঃ সোলাইমান হোসাইন: সম্মান? সেটাতো কিনতে পাওয়া যায়না, এমনকি জোর করেও পাওয়া যায়না। মন থেকেই আসে সম্মান ও শ্রদ্ধার বিষয়টা। এই পৃথিবীতে পিতা মাতার পরেই সম্মান ও শ্রদ্ধার দিক দিয়ে প্রথম কাতারে আছেন শিক্ষকের অবস্থান। কারণ শিক্ষক যে মানুষ গড়ার কারিগর। এই শিক্ষকেরাই যে শিক্ষা দেন কিভাবে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়, কিভাবে সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে, কাকে, কখন শ্রদ্ধা করতে হয়, সম্মান দেখাতে হয়, স্নেহ করতে হয়।


কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে আমার বিশ্বাস করতে কস্ট হয় যখন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই যৌন হয়রানির দায়ে শিক্ষকের চাকুরী গেলো, শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর যৌন হয়রানীর অভিযোগ, শিক্ষকের বিরুদ্ধে সহকর্মীর যৌন হয়রানীর অভিযোগ ইত্যাদি শিরোনাম। এগুলি যে শুধু শিরোনাম হয়েই থাকছে তা নয়। এর ভিতরে অনেক অভিযোগের আবার সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। তাইতো চাকরী হারাতে হচ্ছে কিছু শিক্ষককে। কেউবা চাকরী হারিয়ে আবার ফিরেও পাচ্ছে তার চাকরী। আর কিছু অভিযোগ আবার নামেমাত্র শিরোনাম হয়েই থেকে যাচ্ছে কারণ তাদের সঙ্গে আছে অনেক রাঘববোয়ালদের হাত। কেঁচো খুড়তে গিয়ে যে বেরিয়ে আসবে সাপ! তাইতো অনেক সময় জাতীয়ভাবে নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পরেও কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো তদন্ত বা বিচার কিছুই হচ্ছে না তাদের। বিচার পাচ্ছেনা অনেক ছাত্রীই। বরং অভিযোগকারী ছাত্রীকে বা ছাত্রীদেরকে হতে হচ্ছে নানা রকম চাপের মুখোমুখি। এমনকি ভয় দেখানো হয় ছাত্রত্ব বাতিলেরও। তবে হ্যাঁ, এটাও সত্য যে কিছু অভিযোগ আছে যেগুলি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সেগুলি খতিয়ে দেখলেই তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে আসবে।


এইতো গত ২৪ আগস্ট ২০১৭ সিন্ডিকেট সভায় যৌন নিপিড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্থায়ীভাবে চাকরিচুত্য করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক মোঃ শরীফ উদ্দিনকে। একই অভিযোগে ২২ আগস্ট ২০১৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৬ তম সিন্ডিকেট সভায় চাকরিচুত্য করা হয় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামানকে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়, যৌন হয়রানির দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষককে বরখাস্ত করার খবর। এর এগে ক্লাস রুমে ছাত্রীদের নিয়ে অশ্লীল ও যৌন হয়রানি মূলক আচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫০ তম সিন্ডিকেট সভায় চাকরিচুত্য করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষককে। পরে অবশ্যই হায় কোর্টে রিট করলে ২০১৬ সালে ২৬ জুলাই রায় তার অনূকুলে যায় এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ফিরে পেতে আবেদন করলে প্রশাসন তাকে স্ব-পদে বহালের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ যুগান্তর, প্রথমআলো সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই রকম অভিযোগের কথা জানতে পারি।


এছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপিড়নের অভিযোগ দিয়েছে ছাত্রীরা। বিভিন্ন মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে কুরুচি সম্পন্ন কিছু জুনিয়র শিক্ষক পরীক্ষার খাতায় বেশি মার্ক দেওয়া এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যেমন ছাত্রীদের হয়রানি করে থাকে ঠিক তেমনি কিছু সিনিয়র শিক্ষক তাদের ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে শিক্ষাজীবন শেষে চাকরী দেওয়ার লোভ দেখিয়েও অনেক ছাত্রীর সঙ্গে কুরুচিসম্পন্ন আচরণ করে থাকেন। আর সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদেরকে পিএইচডি সুপারভাইজ করার প্রসঙ্গ তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।


যত দিন যাচ্ছে ততই যৌন হয়রানি যেনো ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। এমনটা যদি চলতে থাকে তাহলে কি হবে আমাদের ছাত্রসমাজের? এগুলি কি ওদের স্নায়ুতে আলোড়ন সৃষ্টি করে না? কাদের কাছে যাবে তারা জ্ঞানার্জনের জন্য? অভিভাবকরা কাকে বিশ্বাস করে তাদের মেয়ে বাচ্চাদেরকে পাঠিয়ে দিবে বাড়ি থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে?


যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক তাদের দায়িত্বকে ব্রত হিসেবে বিবেচনা করে সর্বদা সেটা পালনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সেখানে কিছু অসৎ চরিত্রের শিক্ষক ব্যস্ত কিভাবে ছাত্রীদের সঙ্গে লীলা খেলায় মেতে উঠা যায় এইটা নিয়ে। কিন্তু না, অল্প কিছু নোংরা ও দুশ্চরিত্র স্বভাবের শিক্ষক নামের লম্পটদের জন্য এই অভিযোগের দায়ভার গোটা শিক্ষক সমাজ নিতে প্রস্তুত না। এই কলঙ্কের দায়ভার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা শিক্ষক সমাজের ঘাড়ে চাপানো হয় তাহলে অনেক অভিভাবক আর তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি করাতে চাইবে না। চাইবেন বা কেনো? যেখানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাঁত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের অন্যান্ন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাধিক শিক্ষক একই অভিযোগে অভিযুক্ত, সেখানে কিভাবে, কার উপর আস্থা রেখে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের, বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে আগ্রহী হবেন? আর এমনটি চলতে থাকলে অচিরেই ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এজন্য শিক্ষক নামের এই লম্পটদের জায়গা এ সমাজে না।


তাই বলতে হয় যে, আমরা শিক্ষক সমাজ তো মানুষ গড়ার কারিগর, আমরাই তো ছেলেমেয়ে ও অভিভাবকদের আস্থার জায়গা, সেখানে আমরা যদি আমাদের ছাত্রীদের সঙ্গে বখাটে, লম্পট ও প্রতারকের ভূমিকা পালন করি, তাহলে কিভাবে আমরা তাদেরকে শিক্ষা দিবো? কিভাবে আমরা তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য সুশিক্ষাই শিক্ষিত করে তুলতে সাহায্য করবো? কিভাবে আমরা ভূমিকা রাখবো এই দেশ গড়ার জন্য? কিভাবে গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা?


এই কলঙ্ক কি কোনো আইন করে বা বিচার করে মুছে ফেলা যাবে? না, তা কখনো সম্ভব না। আইন করে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাশ, যুদ্ধাপোরাধীর বিচার করা মানায়, কিন্তু একজন শিক্ষককে যখন যৌন হয়রানির দাঁয়ে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তখন এ লজ্জা আর রাখবো কোথায়? যৌন হয়রানি বা যৌন নিপিড়ন যেটাই বলেন না কেনো, তা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে আমাদের শিক্ষক সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো। আমাদেরকে সবসময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে যে, আমরা শিক্ষক, আমরা ছেলে মেয়েদের অভিভাবক। অভিভাবক হয়ে কিভাবে আমরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারি?


তাই পরিশেষে বলতে চাই, আসুন আমরা শিক্ষক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যৌন নিপিড়ন বা যৌন হয়রানি নামক ভাইরাসকে সম্পূর্ণভাবে নির্মুল করার লক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, নতুন করে শপথ গ্রহণ করি, শিক্ষাঙ্গনে নই আর কোনো যৌন হয়রানি। তারপরেও যদি কোনো শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার এমন জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে বা তাদেরকে শিক্ষক নামের পবিত্র এই সমাজ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতাশালীদের যেনো কোনোরকম হস্তক্ষেপ না থাকে।


মোঃ সোলাইমান হোসাইন,
অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
Email: solaiman_ru@yahoo.com

 

ঢাকা, ২৯ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমএইচ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ