শেখ মোঃ ফায়েকুজ্জামান টিটো : “আমরা শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু কারো ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি নই, কাউকে ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে আমাদের কোন ভূমিকা নেই তাই আমাদের প্রতি এই অবহেলা”
প্রয়োগ আর দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমাজ-শিক্ষা আর প্রগতি মিলে একাকার হয়ে গেছে। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মেধাবিকাশ, উৎকর্ষতা ও জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। শিক্ষা শব্দটির ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার আছে যা ভিন্নভিন্ন অনুষঙ্গে কাজে লাগানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক সম্মানের একটা পেশা মনে করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা। উন্নত বিশ্ব শিক্ষা আর শিক্ষকের কদর জানে বলেই তার আজ উন্নতির স্বর্ন শিখরে।
আমাদের দেশে প্রবাদ আছে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমার প্রশ্ন শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে সেই মেরুদণ্ড তৈরির কারিগর নিশ্চয়ই শিক্ষকেরা। আশা করি এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোন উপায় নেই। দেশ স্বাধীনের আগে আমাদের এই বাংলায় উচ্চ শিক্ষার পথ একেবারেই সংকীর্ণ ছিল। বঙ্গভঙ্গ রদের(১৯১১) পরে পূর্ববঙ্গের মানুষের মধ্যে যে কয়টা দাবি জনপ্রিয়তা অর্জন করে তন্মধ্যে ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল অন্যতম। ১৯১২ সালের মে মাসে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট নাথান কমিশন গঠিত হয়। তাদের সুপারিশক্রমে ১৯২০ সালে ভারতের আইন সভায় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন” পাশ হয়। ১৯২১ সালের ১জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। উচ্চ শিক্ষার দ্বার খুলে যায় পূর্ববঙ্গের মানুষের। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে উচ্চ শিক্ষা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার মহাপরিকল্পনা অনেকাংশেই সফলতার মুখ দেখে। এরপরে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরে উচ্চ শিক্ষা ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত লাভ করে। দেশে এখন সরকারী ৩৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার ৩৭টির কার্যক্রম চলছে বাকি দুটির কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ১০০টি। এত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়েরএকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন ৩০ হাজারের ও বেশি শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা স্রেফ চাকুরী বা অর্থ উপার্জনের জন্য নয় বরং দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনে আত্বনিয়োগ করার মহান ব্রত নিয়েই এই পেশায় আসেন দেশের মেধাবীরা। সম্মান, মর্যাদা আর মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে এই মহৎ পেশাকে বেঁছে নেন অনেকেই। অন্যসব চাকুরীতে যেমন অনেক ভাতা পাওয়া যায়,গাড়ী সুবিধা,কাজের লোক কিন্তু এই শিক্ষকতায় বেসিক বেতনের বাইরে বাড়িভাড়া আর ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতাই যথেষ্ঠ।(একজন প্রভাষকের বেতন, বেসিকঃ২৩১০০+ বাড়িভাড়াঃ ৯২৪০+ চিকিৎসা ভাতাঃ ১৫০০=৩৩৮৪০)প্রশ্নটা এমন যে শিক্ষকের আবার এতকিছুর দরকার কি? পড়াবেন বেতন পাবেন সব চুকে গেল। ঠিক একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-টিচিং প্রফেশনে মানে কর্মকর্তা পদে যারা আছেন তারাও ঐ একই স্কেলে বেতন পান। প্রশ্ন হল এত ভাল ফলাফল করে শিক্ষক হিসেবে যিনি যোগদান করলেন তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী (অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা তো দূরের কথা টেনেটুনে পাশ করে এমনকি ডিগ্রী পাশ করেই) কর্মকর্তারা যদি একই স্কেলে বেতন পান তাহলে পার্থক্য থাকল কোথায়? কর্মকর্তাদের বেতন নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার কথা হল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার তৈরির কারিগরদের অবমূল্যায়ন করে আদৌ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব কিনা এটা বড় প্রশ্ন।
ছাত্র জীবনে অনেক জ্ঞানীগুণী শিক্ষকদের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছি। একবারের অভিজ্ঞতার কথা বলি এক স্যারের সাথে গিয়েছি দাওয়াত খেতে , খাওয়া শেষ করে বাইরে ঘুরতে বের হলাম একটু পরেই দেখি স্যার ব্যাগ থেকে কিছু থিসিস রিপোর্ট বের করলেন। বাইরের নির্মল পরিবেশে বসে তিনি সেগুলো দেখা শুরু করলেন এমনকি আমাকেও ডাকলেন। বিরক্তি(ঘুরতে এসেছি এই সময় কাজ তাই বিরক্তি) নিয়ে আমিও স্যারের সাথে কাজে যোগ দিলাম। স্যার বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি বিরক্ত আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন ফায়েকুজ্জামান রাগ করনা, আমি শিক্ষক আর একজন শিক্ষকের কোন কর্মঘন্টা নেই তাকে সব সময়ই পড়াশোনা-গবেষণা নিয়ে থাকতে হয়। শিক্ষকেরা শুধু চাকুরী করেনা তারা এটা নিজেদের ব্রত হিসেবে নেয় যা দায়িত্ববোধ থেকেই আসে। স্যারের আরেকটা কথা খুব মনে পড়ে তিনি আমায় বলেছিলেন একজন শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কখন গর্ববোধ করেন আমি অনেক ভাবে উত্তর দিয়েছি স্যার সব উত্তরই নাকচ করে বললেন ছাত্র-ছাত্রীরা যখন মেধা-প্রজ্ঞা আর যোগ্যতা বলে শিক্ষক কে ছাড়িয়ে যান তখনই শিক্ষক নিজেকে সার্থক মনে করে গর্বিত হন।
কিছু মানুষের আচরণে মাঝেমাঝে মনে হয় শিক্ষকতা একটা অভিশপ্ত পেশা। যখন শুনি আরে মিয়া আপনি মাষ্টার মানুষ পড়ানোর দরকার পড়াবেন এতকিছু নিয়ে আপনার চিন্তা করার দরকার কি? তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, মনে হয় পেশা পছন্দে আসলেই ভুল করেছি। কিন্তু আবার যখন পত্রিকার পাতায় ছবি দেখি সাবেক শিক্ষা সচিব(বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক) নজরুল ইসলাম খান তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে পা ছুঁয়ে সালাম করছেন তখন গর্বে বুক ভরে যায় নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে আগ্রহ বোধ করি। কাজী কাদের নেওয়াজ এর সেই বিখ্যাত কবিতা শিক্ষা গুরুর মর্যাদা পড়ে শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্ন আজ পুরন হয়েছে।
অষ্টম বেতন স্কেল ঘোষনার পরে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে সারাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ ও ২৩ এ আগষ্ট-২০১৫ একযোগে অর্ধদিবস কর্মবিরতিতে যান শিক্ষকেরা।দুঃখজনক ব্যাপার হল ঐ সময়ে আন্দোলনরত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া তো দূরের কথা পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সম্মানের সাথে চাকুরী টিকিয়ে রাখাই দায়।
আপনি শিক্ষিত জাতি চাইবেন, শিক্ষিত মানব সম্পদ চাইবেন, আপনার সন্তানকে ভাল শিক্ষকদের কাছে পড়াতে চাইবেন কিন্তু যারা পড়াবে সেই শিক্ষকদের সম্মান দিবেন না, তাদের বেতনের কথা চিন্তা করবেন না ,এটা কি হাসির ব্যাপার হয়ে গেলনা? আসল ব্যাপার হল আমরা শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু কারো ক্ষমতায় যাবার সিড়ি নই, কাউকে ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে আমাদের কোন ভূমিকা নেই তাই এই অবহেলা। তবুও আশাবাদী কারন দেশ পরিচালনা করছেন জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যার লক্ষ্যই হল ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত, সুশিক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
আপনার দক্ষ ও সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই মানবেতর জীবন-যাপনের কথা বিবেচনা করে আপনার বিচক্ষনতা দিয়ে আমাদের বিষয়টা দেখবেন।একটা উদাহরন দিয়ে শেষ করতে চাই অতিসম্প্রতি শুধুমাত্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফল স্বরূপ মাহাবুবুল হক ভূইয়া (কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) কে একটা ভিক্তিহীন অভিযোগের জন্য বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য মাহাবুবুল হক ভূইয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুজিব আদর্শের সৈনিক।
শোক দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নিজ বিভাগের অল্প কিছু ছাত্রদের কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাও ছাত্রদের অনুরোধেই। ইনিই তো শিক্ষক, আরে এটাই তো শিক্ষকতা একজন শিক্ষক ৯টা থেকে ৫টা শুধু ডিউটি করেন না , ২৪ ঘন্টাই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিবেদিত। স্যালুট ভাই মাহাবুবুল হক ভূইয়া। শিক্ষকতা শুধু অর্থ বা পদের জন্য না,বিবেকের দায়বদ্ধতার এক মহান ব্রত শিক্ষকতা যা একজন শিক্ষক মনে-প্রাণে সর্বদা ধারণ করেন।
শেখ মোঃ ফায়েকুজ্জামান টিটো
লেকচারার, এ আই এস বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা, ২০ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমএইচ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: