Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা যেভাবে করা হয়

প্রকাশিত: ২৪ মে ২০১৯, ১০:০৭

শান্তা তাওহিদা : বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি? যত সহজে এই প্রশ্ন করা যায়, উত্তর দেয়াটা ততটা সহজ নয়। কারণ কে সেরা কিংবা সেরাদের সেরা সেটা হুট করেই বলে ফেলা যায় না। যেমন ধরুন, আপনাকে কেউ প্রশ্ন করল, বলুন তো আপনার কাছে পৃথিবীর সেরা ফুল কোনটি? আপনি হয়ত বলতে পারেন, রঙে পদ্ম সেরা আর সুভাষে বেলী। আপনার কাছে সুভাষে বেলী সেরা হতে পারে কিন্তু আরেক জনের কাছে হাসনাহেনাও তো হতে পারে। আর ধরুন সেই লোকটি নেদারল্যান্ডের কেউ । তার কাছে তার দেশের টিউলিপ সেরা। ইরানের কারুর কাছে গোলাপ সেরা। হতে পারে কিনা ভাবুন তো। আপনি তাহলে কোন ফুলকে পৃথিবীর সেরা বলবেন? কেন এই তুলনা দিয়ে লেখা শুরু করলাম তা শেষে গিয়ে আবার বলব।

আমাদের প্রথম প্রসঙ্গে ফিরে যাই চলুন। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা কীভাবে নির্ধারণ হয় সে বিষয়ে কম বেশি আমরা সবাই জানি। তবু সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পিছিয়ে আছে তা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা চলছে। এই যে আমরা কেন পিছিয়ে আছি সেরাদের তালিকায়, এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের আলোচনা সমালোচনা চলার মানেই হল আমরা আমাদের দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি চাই। আমরা পিছিয়ে পড়তে চাই না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্থানীয়, জাতীয় সকল ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা রয়েছে আমরা তা নিরূপণের চেষ্টা করছি। সমস্যার গভীরে যেতে চাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন লেখা, মতামত, অভিমত, প্রতিক্রিয়া আমার কাছে একেবারেই নেতিবাচক মনে হয়নি। বরং তারা তাদের অবস্থান থেকে সচেতন শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমাদের বরং তাদের থেকে আরও বেশি শোনা দরকার। আমরা নিশ্চয়ই তাদের কথা শুনব। সেই শুরুটা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে করতে চাই। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে আমরা গঠনমূলক আলোচনার আয়োজন করব খুব শীঘ্রই।

আমরা সবাই মিলে চলুন একটু জেনে নেই, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা আসলে কীভবে করা হয়। আপনারা নিশ্চয়ই সবাই কিউএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি ক্রমতালিকার কথা জানেন। এই তালিকা সারা পৃথিবীজুড়ে অধিক জনপ্রিয় বলে একে দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। কিউএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি ক্রমতালিকা করা হয় ছয়টি বিশেষ মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে।

যা হল-
১। Academic Reputation
২। Employer Reputation
৩। Faculty/Student Ratio
৪। Citations per faculty
৫। International Faculty Ratio
৬। International Student Ratio

এই ছয়টি মানদণ্ডের প্রতিটির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা স্কোর রয়েছে। সবগুলো নম্বর একসাথে মিলিয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা করা হয়। এই নম্বরগুলো দেয়ার পদ্ধতির কিছুটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক ।

Academic Reputation বা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতির জন্য বরাদ্দ ৪০ নম্বর। শিক্ষায় ও গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ হাজার বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে একটি একাডেমিক সার্ভে করা হয়। সেই সার্ভের উপর ভিত্তি করে এখানে ৪০ এ নম্বর দেয়া হয়।

Employer Reputation বা চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতির জন্য বরাদ্দ ১০ ভাগ। পড়াশোনার সাথে চাকুরীর বাজারের কতখানি সঙ্গতি আছে তা বিবেচনা করা হয়। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পাবার কতখানি যোগ্য তা নিয়ে অভিমত দেন চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।

Faculty/Student Ratio বা শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাতের জন্য নম্বর ২০। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলে শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি একাডেমিক বিষয়ে সময় বেশি দিতে পারেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে কম পারেন। এমনকি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে শিক্ষকের ক্লাস নেবার চাপ বেড়ে যায় বলে তিনি তার ব্যক্তিগত গবেষণায় কম সময় পান।

Citations per faculty বা শিক্ষকদের গবেষণার কতটি উদ্ধৃতি অন্য গবেষকদের গবেষণায় কতবার ব্যবহার করা হয়েছে তার জন্য দেয়া হয় ২০ ভাগ নম্বর। শিক্ষকতা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুল কাজ আর এর ফলাফল হল গবেষণা । এজন্য প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিগত ৫ বছরের গবেষণা পত্রের হিসাব গ্রহণ করা হয়। তারপর খতিয়ে দেখা হয় কতটি উদ্ধৃতি অন্য গবেষকদের গবেষণায় কতবার ব্যবহার করা হয়েছে তা গণনা করে নম্বর দেয়া হয়। এর জন্য Elsevier Scopus ডাটাবেজ থেকে সহায়তা নেয়া হয়।

International Faculty Ratio ও International Student Ratio বা আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যার জন্য প্রত্যেক ক্ষেত্রে ৫ ভাগ করে মোট ১০ নম্বর এখানে দেয়া হয়। নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কতখানি আন্তর্জাতিক সুনাম রয়েছে তা এ থেকে ধরে নেয়া হয়। তবে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা করতে কিউএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি ক্রমতালিকা আরও কিছু বিশেষ মানদণ্ডকে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এখানকার মানদণ্ডগুলো নম্বর বিভাজনসহ নজর দেয়া যাক।

Academic Reputation বা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি ৩০ নম্বর, Employer Reputation বা চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি ২০, Faculty/Student Ratio বা শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ৫+৫=১০, International Research Network বা আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ১০, Citations per faculty বা শিক্ষকদের গবেষণার উদ্ধৃতি ৫, Citations per paper বা গবেষণার পেপার উদ্ধৃতি ৫, International Faculty Ratio ও International Student Ratio বা আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৫+৫=১০, পিএইচডি ডিগ্রীধারী শিক্ষক সংখ্যার জন্য ৫ নম্বর। এছাড়াও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদী কোর্স করতে আসা ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদী কোর্স করতে যাওয়ার উপর ২.৫+২.৫=৫ নম্বর দেয়া হয়।

কীভবে হিসাব করতে হয়, কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন কোন মানদণ্ডে কত পেল আমরা যে কেউ চাইলেই তা দেখতে পারি সেজন্য নিচের লিঙ্কে গিয়ে বিনামূল্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। https://www.topuniversities.com/asia-rankings/methodology

এবারে আসুন, কেন এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পিছিয়ে আছে তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। সবার আগে যেটা আমাদের ভাবতে হবে যে, কোন একক কারণে কখনোই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ে না। এটি অনেকগুলো কারণের সমষ্টি। তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল একটি দেশ হিসেবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান কেন্দ্রিক, গবেষণা নির্ভর নয়। আমাদের গবেষণার জন্য বরাদ্দ কম। আমাদের বেকারত্ব সমস্যা, আমাদের দেশের মেধাবীরা উন্নত চাকুরী জীবনের আশায় বিদেশে চলে যাওয়া। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সামাজিক নানা সংকট রয়েছে। তবু আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষাক্ষেত্রে এই এগিয়ে যাওয়ার গতিটা বেশী ধীর বলে হয়ত আমরা সবাই হতাশ হয়ে পরি বারবার। কিন্তু এই ধীর গতির বেগ বাড়নো আমাদের একক চেষ্টায় সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এই সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার বিশেষ মানদণ্ডগুলোর দিয়ে আরও বেশি যত্নশীল হবে আমাদের তাই কামনা।

আমাদের সচেতন শিক্ষার্থীরা হল আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ দশকে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। আমাদের বাবা, মায়েরা চেষ্টা করেছেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার। এবার তারা বিশ্রাম নিক। আমরা তরুণেরা আমাদের দেশকে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একদিন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার দেখতে চাই। একদিন সেই দিন নিশ্চয়ই আসবে। সেদিন দেখতে চাইলে আমার দেশের বেলী, গোলাপ, রজনীগন্ধাকে আগে সেরা ভাবতে হবে। এই ফুলগুলো ফোটাতে সার, পানি, নিড়ানো, আগাছা তুলে ফেলে গাছের যত্ন করতে হবে। এই যত্নের ভার আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের হাতে। ওরা আমাদের পথ দেখাক। আমরা শিক্ষকরা সবসময় আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশে আছি। আমাদের সেরা শিক্ষার্থীরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় যুক্ত করুক বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। জয় বাংলা।

লেখক : শান্তা তাওহিদা
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর
যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা, ২৩ মে (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ