Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

পাবিপ্রবির একজন বাবু কাকা

প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারী ২০২২, ২২:০৬

আবদুল্লাহ আল মামুন: বেলা তখন বারোটা। মধ্য আকাশে সূর্যের প্রখরতা থাকার কথা। তবে সেই মুহূর্তে মেঘে ঢেকে আছে মাথার উপরের আকাশটা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি তখন ঝরে পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, শীতের তীব্রতাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শীত এবং বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কেউ বের হতে চাইবেনা ঘর থেকে। কিন্তু শীত থাকুক আর বৃষ্টি থাকুক গতিময় জীবন তো বয়েই চলে অবিরামে। গতিময় জীবনের একটি ধারায় বয়ে চলছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। শীত আর বৃষ্টিকে উপেক্ষাকে করে শিক্ষার্থীরা চলে এসেছে পরীক্ষা দিতে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে চলে এসেছেন নিজেদের কর্মস্থলে।

কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একজন মানুষের সন্ধানে আছি। একটু মন খুলে কথা বলার ইচ্ছা আমার উনার সাথে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছেনা। এই দেখছি এই দেখছিনা, চোখের পলক ফেলতেই উনি হাওয়া। শীত আর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমিও বের হলাম, উদ্দেশ্য সেই মানুষটাকে খোঁজা। নিজের কিছু আনুষাঙ্গিক কাজ সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার পেরিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দিকে আমার গন্তব্য। উদ্দেশ্য প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো তারা মানুষটার সন্ধান দিতে পারবে।

আমাকে বেশি দূর যেতে হয়নি, কেন্দ্রীয় মাঠ পার হয়ে প্রশাসনিক ভবনের দিকে মোড় নিতেই প্রশাসনিক ভবনের সামনের ফুলের বাগানের দিকে আমার চোখ চলে গেলো। আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে গেলাম। মানুষটি আপন মনে একটা কাস্তে হাতে বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন। এই মানুষটাকে সবাই কাজের মধ্যেই খুঁজে পায়, যখনই দেখা মেলে তখন তিনি কাজে ব্যস্ত।

উনার পুরা নাম মঙ্গল শেখ বাবু মন্ডল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কাছে তিনি বাবু কাকা নামেই পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বাবু কাকা এক পরিচিত নাম, এক ভালোবাসার নাম। কাজের একাগ্রতা আর সরল একটা মন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার মন জয় করে নিয়েছেন।

কাজে ব্যস্ত বাবু কাকা

 

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই বাবু কাকা এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারেরই একজন। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করেন। রাজাপুরের সেই ফসল ভরা মাঠ থেকে আজকের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সব কিছু বাবু কাকার সামনে দিয়ে ঘটা। তাইতো বলছেন-‘’এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি প্রফেসর ড. আমিন উদ্দীন মৃধা স্যার থেকে আজকের ভিসি প্রফেসর ড. এম রোস্তম আলী স্যার সবাই আমার চোখের সামনে দিয়ে এসেছেন। সেই ফসলি জমি থেকে আজকের এতগুলো বহুতল ভবন সবকিছুই আমার স্মৃতিতে এখনো পরিষ্কার হয়ে আছে’’।

এক মনে কাজ করতে থাকা বাবুর কাকার সাথে আমি গিয়ে আলাপ জমাতে শুরু করি। তবে আমার কথা যে উনার কাজে খুব ব্যাঘাত ঘটিয়েছে সেটা বুঝা যায়নি। হাতে কাস্তে দিয়ে বাগানের আগাছা তুলছেন অন্যদিকে আমার সাথে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলাম-“কাকা এই শীতের দিনে কাজ করতে নেমে গেছেন কেউ কী আপনাকে দায়িত্ব দিলো নাকি”? কাকা জবাব দিলেন-“ব্যাটা, কেউ আমাকে দায়িত্ব দেওয়া লাগে নাকি! এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার, এটাকে সুন্দর রাখাও যে আমার দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢুকেই যদি দেখে বিশ্ববিদ্যালয় অপরিষ্কার তাহলে লোকে ভাববে কী! এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের বাগানটার যত্ন নিচ্ছি ভালো করে যেন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই বুঝতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টা সুন্দর”।

এরপর ধীরে ধীরে আলাপ জমতে থাকে। বাবু কাকা বলতে থাকেন অনেক কথা। আজকের বঙ্গবন্ধু হল যেখানে সেখানেই বাবু কাকার বাড়ী ছিলো। সরকার জমি অধীগ্রহন করার পর জমি কিনে বাবু কাকা আবার নতুন বাড়ী করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে। এক ছেলে আর স্ত্রী সহ মাত্র তিনজনের পরিবার বাবু কাকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলের চাকরির জন্য প্রথমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হোন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি বিভাগে চাকরি হয় ছেলের। ছেলের চাকরিটা হয়ে যাওয়াতে অনেকটা নির্ভার হোন বাবু কাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে কাজ করতেন পাবনা শহরের আবদুল হামিদ রোডে ফ্রিজ, এসির দোকানে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর সেই কাজ ছেড়ে চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নির্ধারিত কোন চাকরি ছিলোনা। যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই খেটেছেন। কখনো পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ পেয়েছেন কখনো পাননি। কেউ টাকা দিবে বলে কাজ করিয়ে নিয়েছেন কিন্তু টাকা দেননি, আবার কেউ দিয়েছেন। তবে এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই বাবু কাকার। বাবু কাকার ভাষায়-“এখানে কাজ করে সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই তো আমার বড় পাওয়া। ছাত্ররা আসে কথা বলে, আমার সাথে ছবি তোলে এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী আছে! দুনিয়ার আর কয়দিনের! একজনের সাথে অন্যজনের ভালোবাসাই বড়। আমি সবার সেই ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আক্ষেপের কিছুই নেই”।

হ্যাঁ, বাবু কাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছেন। বাবু কাকা সবার কাছেই আপন একজন মানুষ, সদা হাস্যোজ্জল, খোলা মনের অধিকারী একজন ব্যক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ছাত্রনেতারা সবাই বাবু কাকার আপন মানুষ। ছাত্রনেতাদের প্রসঙ্গ টেনে এনে বাবু কাকা বললেন-“সেই সবুজ (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক) থেকে শুরু করে আজকের আসিফ (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি), বাবু (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) সবাই আমার চোখের সামনে দিয়েই রাজনীতিতে এসেছে। কখনো খারাপ কিছু করেনি আমার সাথে। সবুজ ক্যাফিটেরিয়ায় বলে দিয়েছে (বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটিয়ার বর্তমান ঠিকাদার) বাবু কাকা এখানে এসে খাওয়া দাওয়া করলে যেন পয়সা না নেয়। অনেক সময় গিয়ে খেয়ে আসি। টাকা নেয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার খাওয়ার অভাব হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন ফাংশনে আমার দাওয়াত থাকেই”।

বাবু কাকা

 

কথা বলতে বলতে বাবু কাকার সাথে প্রশাসনিক ভবনের সামনের বাগানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে যাই। বাবু কাকার হাতে অনবরত খুপড়ি চলছেই। পুরা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে তখন ফুলের বাগানের প্রসঙ্গ না তুলে পারলাম না। এ প্রসঙ্গ তুলতেই বাবু কাকা চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. হাসেবুর রহমানের কথা। তিনি বলতে থাকেন- “প্রক্টর স্যার আসার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সুন্দর করার কাজে নেমে গেছেন। যেখানে যেখানে ফুল গাছ লাগানো প্রয়োজন সবখানে ফুল গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। সাথে আমাকে রেখেছেন। এইসব ফুল গাছ দেখার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আমি এখন ফুল গাছগুলোর যত্ন নিই। প্রক্টর স্যার প্রতিদিনই এগুলোর খোঁজ খবর নিচ্ছেন”।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রক্টরের উপর উনি অনেক খুশি। একটা সময় প্রশাসন থেকে কাজ করিয়ে নিতো কখনো টাকা দিতো কখনো টাকা দিতোনা। কিন্তু বর্তমান প্রক্টর উনার কাজের বিনিয়ময়ে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ঠিক মতো টাকা পাচ্ছে কিনা সেটার খোঁজ নিচ্ছেন। একই সাথে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উপরও খুশি। বাবু কাকা বলেন-“এখন আর কেউ টাকা মেরে খাওয়ার সাহস পায়না। প্রক্টর স্যার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভিসি স্যার সবাইকে বলে দিয়েছে আমার টাকা যেন কেউ না আটকায়”।

অনেকেই হাঁটতে গিয়ে ফুল গাছ ভেঙে ফেলছেন, মাড়িয়ে দিচ্ছেন এগুলো দেখে আপনার কষ্ট লাগেনা? এক কথা জিজ্ঞেস করতেই বাবু কাকা বলে উঠলেন-“কষ্ট তো লাগেই ব্যাটা। কিন্তু কী করবো! যারা ফুল গাছ ভাঙছে, পা দিয়ে মাড়িয়ে দিচ্ছে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছেলে-মেয়ে। তাদের উপর তো আর রাগ করে থাকা যায়না। তাই নিজে গিয়েই ঐ গাছগুলোর যত্ন নিই, নতুন করে গাছ লাগিয়ে আসি”।

বাবু কাকা সব সময় পরিচ্ছন ক্যাম্পাস দেখতে চায়। বিভিন্ন সময় লেকের পাড়, মাঠের পাশে শিক্ষার্থীরা ময়লা ফেলে রাখে। এগুলো দেখে বাবু কাকার খারাপ লাগে। সেটা এভাবেই বললেন-“বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন। এখানে ময়লা আবর্জনা জমে থাকলে খারাপ দেখায়। তাই নিজে যখনই দেখি কোথাও ময়লা পড়ে আছে সেগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে আসি”।

বাবু কাকার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক সময় হয়ে গেছে। খেয়ালই করিনি সময় যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে। বাবু কাকার সাথে কথা অসমাপ্ত রেখে দিলাম। বলে আসলাম আরেকদিন সময় করে আবার আপনার কথা শুনবো।

বিশ্ববিদ্যালয় ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই ভিন্ন এক রূপে সজ্জিত হবে পুরো পাবিপ্রবির ক্যাম্পাস। তখন কেউ বাগানে নিজের ছবি তুলবে, কেউ ফুলের ছবি তুলে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের টাইমলাইন সাজাবে। কিন্তু এই ফুলের মালিকে কি কেউ স্মরণ করবে? কেউ হয়তো করবে, কেউ করবেনা।

বাবু কাকারা অবশ্য কারও স্মরণে থাকার জন্যে কাজ করেন না! বাবু কাকারা কাজ করেন নিঃস্বার্থে, অন্যের জন্য কাজ করেই যে বাবু কাকাদের আত্মায় প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে, বুক ভরে উঠে ভালোবাসায়। সব সময় কাজে ব্যস্ত পাবিপ্রবির এই নিবেদিত প্রাণ বাবু কাকা কোনদিন ক্যাম্পাস থেকে চলে গেলে হয়তো বেশিদিন কেউ মনে রাখবেনা। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রতিটি গাছ-গাছালি, প্রতিটি বালু কণা ঠিকই বাবু কাকাকে মনে রাখবে। কারণ ঐসব গাছ-গাছালি আর বালু কণার সাথে যে বাবু কাকার আত্মার সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রতিনিধি, ক্যাম্পাসলাইভ২৪ডটকম, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমজেড


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ