আমার রুমম্যাট দুই বছর ধরে বেকার। সরকারি চাকরি করবে। ভাল স্টুডেন্ট, ভাল ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করেছে। সারা দিন রাত চাকরির জন্য পড়াশোনা করে। দুই বছর ধরেই পড়ছে।
আমি তার রুমম্যাট হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি রাত ৪ টা পর্যন্ত পড়ে আবার আমি সকালে অফিসে আসার সময়ও দেখি সে পড়ছে।
অফিস থেকে ফিরেও দেখি সে পড়ছে। আমি এমন একটা মুহূর্ত কখনও দেখিনি যে সে পড়ার টেবিলে নেই।
সব ধরনের চাকরির পরীক্ষায় সে টিকেছে, ভাইভাও দুর্দান্ত ভাল দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর চাকরিটা হয় না। দুই বছর ধরে তার এই অবস্থা।
মাস শেষে বাবার কাছে টাকা চাইতে ফোনটা সে করে ছাদে গিয়ে। আমাদের সামনে করে না। ছাদ থেকে ফিরে আসার পর দেখি তার মুখ চোখ লাল হয়ে থাকে।
কিছুদিন আগে রুপালী বাংকের ফলাফল দেবার আগে সে বলছিল এবার তার চাকরিটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। আমি বললাম কত টাকা ঢালছিস?
সে প্রথমে একটু রাগ করেছিল আমার কথায় কিন্তু কিছুক্ষন পরে আমার বিছানার পাশে এসে বলল "দোস্ত বাড়িতে সামান্য জমি ছিল। বাবাকে অনেক কষ্টে বলে কয়ে রাজি করিয়েছি।
আমি বললাম টাকাটা কাকে দিয়েছিস? ব্যাংকের এমডি সরাসরি টাকাটা পাইছে এবার চাকরিটা confirm !!! এই বলে সে গান গাইতে গাইতে বাথরুমে ঢুকল। আমি ভাবলাম যাক এবার একটা গতি হল।
দিন কয়েক আগে আমি অফিস থেকে ফিরলাম রাত করে। রুমে ঢুকেই দেখি সব বিছানা, টেবিল, চেয়ার এলোমেলো।
আমি পাশের রুমের জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনাটা কি। ওরা বলল মিজান নাকি রুমে এসে এসব করছে। আজকে রুপালী ব্যাংকের result হয়েছে।
ওর চাকুরী টা হয় নি।
আমি ছাদে গেলাম, গিয়ে দেখি ও এক কোনায় বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে।
আমি কতক্ষণ ওর আসেপাশে ঘুরলাম। ওর হাব ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। শেষে আমি নিজেই ওর পাশে বসলাম। বললাম "টাকাটা কি ফেরত দিবে না?"
ও বলল "মনে হয় না। এসব টাকা কী আর ফেরত পাওয়া যায়। "আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম, ওর শরীর কেঁপে উঠল, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো " বাবা সামান্য একটা কৃষক।
ঘরের বড় ছেলে আমি, ছোট দুইটা বোন আছে। বিয়ে দিতে পারছি না, টাকার অভাবে। বাবা কত কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে আমারে পড়াশোনা করালেন। শেষে যেটুকু জমি ছিল সেটাও বেচে দিলেন এই চাকরিটার জন্য। কিন্তু আমি পারলাম নারে।
আমি শেষ হয়ে গেলাম। আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমি এখন কি করব, আমি কোন মুখে ওদের সামনে দাঁড়াবো।"
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। এই কথার কোন জবাব নেই। জবাবটা জানে এই দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা। দুর্নীতিবাজ আমলারা।
তাদের কাছে জবাব চাওয়াও যায় না। তারা অনেক ক্ষমতাবান। জবাব চাইতে গেলেও হয়ত বিনিময়ে তারা কিছু চেয়ে বসবে।
শেষে জীবন নিয়েও টানাটানি। তবে একদিন লাখ লাখ মিজান এক বিন্দুতে দাঁড়াবে।
বিন্দুটা বিস্ফোরণ হলে ওই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমগুলো হয়ত আর অক্ষত থাকবে না।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামনে ধাক্কা দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে ?
আমি ওকে ছাদে একা রেখে নেমে গেলাম। নিজের মত করে একটু কাঁদুক। এই শহরে প্রাণ খুলে কাঁদার মতোও একটু জায়গা নেই।
[কালেক্টেড
খালেদ ইমরান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//জেএন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: