মিনার আল হাসান: পুরান ঢাকার মোহিনী মোহন দাস লেনে মিলবে একটি চৌকোনা বাড়ি। এটিই ঢাকা কেন্দ্র। ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে দুর্লভ এক সংগ্রহশালা ঢাকা কেন্দ্র। তাই ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বলা হয় ঢাকা কেন্দ্রকে।
১৯৯৭ সালে পুরান ঢাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব প্রয়াত মাওলা বখশ সরদারের ছেলে আজিম বখশ নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন মাওলা বখশ সরদার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এর পাঁচটি প্রকল্প আছে। একটি হচ্ছে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চা। এরই ফসল হলো ঢাকা কেন্দ্র। কেন্দ্রের দোতলায় আছে ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংক্রান্ত সাত হাজার বই সমৃদ্ধ পাঠাগার।
এ ছাড়া পুরান ঢাকাবাসীর ব্যবহার্য নানা সামগ্রী, ছবি, ঐতিহাসিক নানা দলিল, মানচিত্র, বুড়িগঙ্গার পারে পত্তন হওয়া সেই আদি নগরের বর্ণিল স্মৃতিচিহ্ন। বসবাসযোগ্যতার নিরিখে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে অনুপযোগী শহরটিকে মেলাতে পারেন না দর্শনার্থীরা। বই আর নানা নিদর্শনের সঙ্গে উদ্যানহীন শহরে বৃক্ষশাখার দোলানো বাতাস পাওয়া যায়।
দোতলায় অন্তত ১০০ প্রজাতির অর্কিডের বাগান যে কাউকে যান্ত্রিক অসহ্য নগরীর বিষন্নতা থেকে খানিকটা হলেও মুক্তি দিবে। যান্ত্রিক নগরে এ যেন একখণ্ড সবুজ ঢাকা। কিছু মানুষের উদ্যোগ, নিরন্তর শ্রম একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, তা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
ঢাকা কেন্দ্রে রয়েছে একটি সুবিশাল পাঠাগার। পাঠাগারের পাশে ছোট জাদুঘরে পুরান ঢাকার বনেদি কয়েকটি পরিবারের ওপর আলাদা করে গ্যালারি আছে। এখানে এসব পরিবারের দুর্লভ সব ছবি, পানের ডিব্বা থেকে শুরু করে রান্নার তৈজস, হুঁকা, শাড়ি-কাপড়, লবণদানি স্থান পেয়েছে। সংগ্রহশালায় রয়েছে ১৮৯৬ সালে তৈরি একটি জমির দলিল।
এর ভাষার অভিনবত্ব আগ্রহী গবেষকের খোরাক যোগায়। এ ছাড়া ঢাকায় প্রথম স্থাপিত মোটর সারাই কারখানার নানা যন্ত্রাংশ, প্রাচীন মানচিত্র, পুরনো ভবনের ইট-নকশা রয়েছে। অসংখ্য দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে এই ঢাকা কেন্দ্রে।
প্রায় দুই দশক ধরে পাঠাগারটি অজস্র পাঠক, গবেষকের প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছে। এই নগরের কোনো কিছু নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করতে গেলে ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া অনেকটা অসম্ভব। অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংক্রান্ত বই পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই এখানে আসেন এসব বইয়ের সন্ধানে। পেয়েও যান কাঙ্খিত বই।
এখানে আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন, আবু যোহা নূর আহমদের উনিশ শতকের ঢাকার সমাজজীবন, কেদারনাথ মজুমদারের ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস, নাজির হোসেনের কিংবদন্তীর ঢাকা, নির্মল গুপ্তের ঢাকার কথা, যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস, রফিকুল ইসলামের ঢাকার কথা, সত্যেন সেনের শহরের ইতিকথা, হরিদাস বসুর ঢাকার কথা। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ঢাকার ওপর সবই মিলবে এখানে।
ঢাকার নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে প্যাট্রিক গেডেস বই লিখেছিলেন ১৯১৭ সালে, ‘ঢাকা : অ্যা স্টাডি ইন আরবান হিস্ট্রি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকদের আরও অনেক দূর্লভ বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালা এই ঢাকা কেন্দ্র। এই পাঠাগারে যে কেউ যেতে পারেন। বেলা চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে যারা গবেষণার কাজে আসেন, তারা অধিক সময় এখানে বসে কাজ করতে পারেন। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে।
ঢাকা কেন্দ্র সম্পর্কীয় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৫ শিক্ষার্থী মিনার আল হাসান, চুমকি দেবনাথ, নার্জিয়া খানম, জে ,এফ শাকিল এবং নাজনীন নহার রিপা। তারা ঢাকা কেন্দ্রের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। তারা বলেন, এমন শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ কোথাও দেখিনি। সব ধরনের তথ্য সহায়তা পেয়েছি।
ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আজিম বখশ থাকেন গুলশানে।
আসতে এবং যেতে তিন ঘন্টার মতো লাগলেও ঢকার জ্যাম উপেক্ষা করে পারিবারিক স্মৃতিবাহী এ কেন্দ্রের টানে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন। সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করেন তিনি। পাঠাগারে আসা অনেকেই তাকে ঢাকার জীবন্ত ইতিহাস নামে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের যে প্রান্তে ঢাকাকেন্দ্রিক যা কিছু পান, তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি।
আজিম বখশ বলেন, এই কেন্দ্র যদি কারও সামান্য উপকারে আসে, সেটিই আমার সার্থকতা। তিনি আরো বলেন, ঢাকার সবচেয়ে পুরনো এলাকা ফরাশগঞ্জ। তখনকার দিনে ঢাকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল এখানে। লঞ্চঘাট, নাট্যমঞ্চ, গানের দল, পাঠাগার সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকত। সেই দিন তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবুও তোমাদের মাধ্যমে সেই দিনগুলোর বার্তা পৌঁছে দিতে চাই।
মিনার আল হাসান
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা, ১৩ সেপ্টেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: