বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছেলেটি। ২০০১ সালে তিনি ভর্তি হন স্বপ্নের ক্যাম্পাসে। ভর্তি হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একই সেশনের এক ছাত্রীকে ভালো লেগে যায় তার। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। দুটি অচেনা মনের মিলনের একটি গল্প রচিত হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
পরের ইতিহাসটা এই রকম, একদিন মেয়েটি ফোন করে ছেলেটিকে জানাল,"তার বিয়ের কথা চলছে"। নিমিষেই সুন্দর সব অনাগত ভবিষ্যতের কোমল স্বপ্নগুলো ডুবন্ত তারার মত ঝাপসা মনে হল। মা না থাকলেও বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে টাকার অভাব ছিল না ছেলেটির। ছোট ছেলে হিসেবে পরিবারে সবার কাছ থেকে এক অদ্ভুত মায়ার স্রোত তার দিকে বহমান ছিল। তবু প্রথম বর্ষে কেমনে কী? সমাজ বলে একটা কথা থেকে যায়।
প্রথম বর্ষে বিয়ে সেকি এক মহা কাব্যিক ট্র্যাজেডি। তার উপর পালিয়ে বিয়ে। মানুষ যতই বড় হোক সমাজের উর্দ্ধে যেতে পারে না। একদিন ছেলেটি মেয়েটিকে সাহস নিয়ে বলে দিয়েছিল, "আমি তোমাকে বিয়ে করব"। কয়েদিন পরে কয়েকজন বন্ধুর সুবাদে বিয়ের কাজটা সেরে নিলেন তারা। বন্ধবীর বেশে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দিনশেষে বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে নিল।
পরেরটা কাহিনী...
সারারাত বাবার চোখের অজস্র জলের ধারা বয়ে বউ হিসেবে মেনে নেওয়া। সবই হল। তবু প্রথম বর্ষে বিয়ে? পরিবারের স্বপ্ন? ভাইয়ের স্বপ্ন? সমাজের স্বপ্ন বলে কিছু একটা থেকে যায়।
পরের ইতিহাসটা মনে হয়েছিল শেকসপিয়ারের ট্র্যাজেডির চেয়েও ভয়ংকর। যেই ছেলেকে কোনদিন টাকার টেনশন করতে হয়নি। বাবা, ভাই, বোন, মামা সবাই টাকা পাঠাত। মুহূর্তেই চিত্রপট ভিন্ন। সবাই জটলা করে সিদ্ধান্ত নিল, "যেহেতু সে আমাদেরকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে তাকে আমরা আর টাকা দিব না"।
বাবা বললেন, আমি তোমাদের একজনের খরচ বহন করব বাকিটা তোমাদের ম্যানেজ করতে হবে। ভগ্ন হৃদয়ে ক্যাম্পাসে আসলো সেই ছেলে। কম ভাড়ার একটা বাসা ভাড়া নিলেন তারা। শুরু হল প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রের জীবন সংগ্রাম। জীবনকে উপভোগ করার সাংসারিক ঝামেলা।
পরীক্ষা, টিউটরিয়াল, এসব চিন্তার পরিবর্তে সে এখন চিন্তা করে, বাসা ভাড়া, বউকে শাড়ি কিনে দেওয়ার আড়ালে একটি কোমল চাঁহনির সে কি অদ্ভুত এক ফন্দি। সন্ধ্যায় টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মোবাইলে রিং, কল পিক করতেই, বাসায় চাল নেই, কোনদিন ডাল নেই, আরও কত্ত কি? এই যে কঠিন এক বাস্তবতার সামনে দুইজন নিরীহ প্রাণী। তাদের অপরাধ শুধুই ভালোবাসা। এক সময়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ছেলেটি বই সার্ভিসিংয়ের কাজ শুরু করে দিল। বিভিন্ন দোকানে দোকানে বই দিয়ে আসত দিন শেষে কয়েকটা কয়েন পকেটে গুজে রুমে যেত।
বাকিটা ইতিহাস?
ছেলেটি এখন তানভীর স্যার, ২০০৮ সালে অনার্স শেষ করে বিভিন্ন কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তিনি। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের প্রথম ডিজিটাল কলেজ "সাউথ এশিয়ান কলেজ" প্রতিষ্ঠা করেন সেই ছেলেটি। কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন ওই কলেজে। ইতিমধ্যে ইংরেজিতে ২৮ টি বই লিখেছেন। হাজার হাজার টাকার ব্যাবসা। চকবাজারে এমন কোন জীব নেই যে উনার নাম শুনেননি। চট্টগ্রামের সমসাময়িক ইংলিশ টিচারদের মধ্যে সেরা টিচার।
এটাকে বলে ক্যরিয়ার। ক্যারিয়ার মানে শুধুই বিসিএস ক্যাডার নয়। এর বাইরেও কিছু থেকে যায়।
এটাকে বলে প্রবল ঘূর্নিবায়ুতে স্থির থেকে পথ চলা।
এটাকে বলে বউয়ের মুখে এক চিমটি হাসি ফোটানোর জন্য প্রথম বর্ষের ছেলে নামক বালকটির নিরন্তর সংগ্রাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে Who the next, ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রোগ্রামে ওই শিক্ষক নিজের মুখে অকপট, সংকোচহীনচিত্তে ওই বয়ান শুনিয়েছেন। উনি আমাকে চিনে না কিন্তু আমি উনাকে চিনি এবং ভালভাবেই চিনি।
"লিজেন্ডরা মানুষকে চিনেনা। লিজেন্ডদেরকে মানুষরা নিজ থেকে চিনে রাখে""
আমি ক্যারিয়ারের বাস্তব সংজ্ঞা আজ আবিষ্কার করতে পারলাম।
লেখক : মুহাম্মদ হামেদুর রহমান (মুকুটহীন সম্রাট?)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//সিএস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: