Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বার ২০১৬, ০৩:১৯

 

 শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: নিউমোনিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নিউমোনিয়ার চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে প্রতি বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে। ১০ বছর আগে দেশে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হতো।

বিশ্বজুড়ে প্রতি ২০ সেকেন্ডে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে একজন করে নিউমোনিয়ায় প্রাণ হারায়। শিশুমৃত্যুর এই হার এইডস ও ম্যালেরিয়ায় সম্মিলিত প্রাণহানির চেয়েও বেশি। ২০০৯ সালে ১২ নভেম্বরকে ‘নিউমোনিয়া দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। এরপর থেকে বাংলাদেশে দিবসটি প্রতি বছর পালন করা হয়। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।

চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। যার আনুমানিক সংখ্যা ৬০ লাখ এবং প্রতি বছর ৫ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ৯৩ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়।

সে হিসেবে দিনে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০ শিশুর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে ৫৪ শতাংশ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হলেও বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৩৭ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ লাখ মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে ৫ বছর বয়সের নিচে প্রায় ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে। ভারতে এ সংখ্যা ৪ লাখের কিছু বেশি।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৩ হাজার ৯৫৫ শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল ৩ হাজার ৩৭৮ জন। এই সময়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১৩৬ শিশুর মৃত্যু হয়।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের জন্য বিশেষ কোনো ঋতুকে দায়ী করা যায় না। এ রোগ থেকে শিশুকে মুক্ত রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, জন্মের পর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে থাকা নিশ্চিত করা। পাশপাশি মা ও পরিবারের সবার স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নিউমোনিয়া রোধে পিসিভি বিশ্বের সর্বাধুনিক ও উন্নত কার্যকর ভ্যাকসিন হলেও হাতেগোনা কয়েকটি দেশ এ ভ্যাকসিনের সুবিধা পেয়েছে। চলতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে এ ভ্যাকসিন দেয়া হবে। বাংলাদেশে নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অতিকার্যকর প্রতিষেধক আসতে আরো দু-এক বছর লাগতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এখন পর্যন্ত এ প্রতিষেধকের ব্যবহার শুরু হয়নি। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এখনো গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ই রয়েছে। নিউমোনিয়া দিবসটি নতুন হওয়ায় তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, `নিউমোনিয়ার বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি এ দেশে পাওয়া যায়, আবার কোনোটি পাওয়া যায় না। যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো দিলেই যে শতভাগ নিউমোনিয়ামুক্ত হওয়া যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

চিকিৎসকের মতে, `নিউমোনিয়ার সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষেধক নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিভি) দেশে চালু করার আগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিতে হবে। নয়তো অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ কোনো নির্দিষ্ট এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর যেকোনো ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে। অন্য দেশে কোনো ভ্যাকসিন কার্যকর হলে সেটা আমাদের দেশেও কার্যকর হবে- এমন নিশ্চয়তা নেই।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিউমোনিয়ার কারণে ফুসফুসের মূল অংশে পানি জমে যায়। ফলে ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং কার্যক্ষমতা কমে যায়। নিউমোনিয়ার প্রভাবে সর্দি-জ্বর, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কফসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন বেসরকারিভাবে বাজারে পাওয়া যায়। এটা খুবই ব্যয়বহুল। এ ভ্যাকসিন সরকারিভাবে আনা গেলে অনেক সহজলভ্য হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নিউমোনিয়া রোধে পিসিভি বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত কার্যকর ভ্যাকসিন হলেও হাতে গোনা কয়েকটি দেশ এ ভ্যাকসিনের সুবিধা পেয়েছে। গ্যাভির (দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) অনুমোদন পাওয়ার পরই কেবল এ ভ্যাকসিন সুবিধা পাওয়া যাবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর অনুমোদন লাভের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আগে থেকেই নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ অনুযায়ী সাধারণ কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জি টাইপ বি (হিব) ভ্যাকসিনও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ অনুযায়ী ৫ বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে উপনীত হয়েছে। বিশ্বের যে ৬টি মাত্র দেশ ১৯৯০ সালের তুলনায় বর্তমান শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তবে এখনও ৫ বছরের কমবয়সী অনেক শিশু প্রতিরোধযোগ্য ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার কারণে মারা যায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুমৃত্যু ও অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক নিরীক্ষা অনুযায়ী এখনও বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। যেমন শুধু ২০১২ সালে শিশুমৃত্যুর শতকরা ১৭ ভাগ বা ১১ লাখ মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়াই দায়ী। এসব মৃত্যুর শিকার শিশুদের ৮০ শতাংশের বয়সই ২ বছরের নিচে।

নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে,শতকরা ৭৫ ভাগই ঘটে মাত্র ১৫টি দেশে। বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর শতকরা ২৫ ভাগই নিউমোনিয়ার কারণে হয়ে থাকে।

দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা যায় না। দরিদ্র দেশগুলোয় এ সমস্যাটা আরও বেশি। যেমন নিউমোনিয়া চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১১-এর তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায় তার মাত্র ৩৫ শতাংশ মানসম্মত চিকিৎসা কেন্দ্র বা দক্ষ চিকিৎসকের চিকিৎসা পেয়েছে, ৪৬ শতাংশ শিশু অদক্ষ চিকিৎসকের কাছে সেবা নিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ শিশু কোনো চিকিৎসাই পায় না। এছাড়া যেসব অভ্যাস নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে যেমন ৬ মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান, ৬ মাস পূরণ হওয়ার পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বয়স অনুসারে পারিবারিক বাড়তি খাবার খাওয়ানো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বায়ুদূষণ কমানো ইত্যাদি দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশে তেমনভাবে প্রচলিত নয়। ফলে এসব দেশে শিশুমৃত্যুর হার আরও বেশি।

রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ, কার্যকর ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থা থাকলেও তা সঠিক সময়ে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা বিদ্যমান প্রথাগত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাই রোগাক্রান্ত পরিবারের মধ্যে ফলপ্রসূ চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া আসলেই একটি চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৫ বছরের কমবয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া ঘটিত মৃত্যুহার কমাতে নব্বইয়ের দশক থেকে কাজ করে যাচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্য ধরে রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই শিশুমৃত্যুর হার আরও কমাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং সরকারের আন্তরিকতা। অন্যথায়, নিউমোনিয়া’র মতো একটি প্রাণঘাতী রোগ মোকাবেলা করা আদৌ সম্ভব নয়। নিউমোনিয়া নির্মূলে সরকারের আশ্বাস বাস্তবে রূপায়িত হবে, সেটাই কাম্য।

লেখক : সাংবাদিক।
jsb.shuvo@gmail.com

 

ঢাকা, ১২, নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এএম


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ