ঘরের দুয়ারে কড়া নাড়ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। একমাসের সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিম উম্মাহর ঘরে হাজির হয়েছে রোজার ঈদের পূর্বমুহূর্ত। প্রতিবছর এই দিনে আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার নিয়ে সকলে মেতে ওঠে সীমাহীন আনন্দে। ঈদকে ঘিরে কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম প্রস্তুতি চলতে থাকে।
তবে এবার হয়ত সেই চিরচেনা ছবি দেখতে পাওয়া যাবে না। লাখ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে করোনা পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক মহামারীতে। সংক্রমণ ঠেকাতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউনের মতো পদক্ষেপ। এতে করে ঈদের আনন্দ ম্লান হবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
করোনার প্রভাব পড়েছে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ঈদ ভাবনায়ও। মহামারী এ ভাইরাস তাদের ঘরবন্দী করে রেখেছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রতিবছর বর্ণিল আয়োজনে শিক্ষার্থীরা ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিলেও মহামারীর কারণে গত বছরের ন্যায় এবারও শিক্ষার্থীদের সেই প্রস্তুতি যেন অনেকটাই সাদামাটা। করোনাকালীন এই সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের ঈদ ভাবনা তুলে ধরেছেন ক্যাম্পাসলাইভ২৪ডটকমের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি) প্রতিনিধি জিহাদুজ্জামান জিসান।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ ফয়সাল মুরাদ ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, "ঈদ আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক আনন্দ। করোনা মহামারী যেভাবে আমাদের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে, জীবন কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, জীবিত মানুষদের স্বজন হারানোর বেদনা থেকে একটু হাসি, আনন্দ, খুশি নিয়ে আসুক ঈদ। নির্জীব হয়ে যাওয়া মানুষগুলো একটু সুবাতাস গ্রহণ করুক, করোনা মহামারির মাঝেও যারা রমজানের সকল ত্যাগ স্বীকার করে জীবনের কঠিন পরীক্ষার হলে আর্তনাত করছে৷
গত কয়েক বছরের ঈদ আমার কাছে একইরকম। নিজের আত্মতুষ্টি দিয়ে ঈদ কখনো পূর্ণতা পায় না। হাজার হাজার পথ শিশু, শহরের বিশাল বড় বড় অট্টালিকার মাঝের রাস্তায় ফুটপাত বা ওভারব্রীজে না খেয়ে থাকা মানুষগুলো যখন ঈদের দিনে পুরাতন ছেঁড়া পোশাকে নিজের শরীর ঢাকে, আমার কয়েক হাজার টাকার পাঞ্জাবীতে তখন রক্তের দাগ দেখতে পাই। সেই অসহায় মানুষদের খাবারগুলো দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা, তারা আমার ফেলে দেওয়া ডাস্টবিনের খাওয়া তুলে নিজের সন্তানের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
এমন ভাবে ঈদের আনন্দ আমি ভোগ করতে চাই না। করোনা মহামারীতে সবচেয়ে কষ্টের দিন পার করছে একই লাল রক্তের কত না অসহায় ভাই বোন। তাদের নিয়ে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নিতে পারা আমার কাছে সৌভাগ্যের, তাহলেই আমার ঈদ আনন্দ বয়ে আনবে প্রাণে প্রাণে।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা ক্যাম্পাসলাইভকে জানিয়েছেন, "দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর সবার মাঝে আনন্দ নিয়ে আসে ঈদ উল ফিতর। তবে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছর থেকে দেশবাসী ভিন্নভাবে সকল উৎসব পালন করছে। ইতিমধ্যেই করোনা মহামারী বিশ্ব থেকে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সংকটময় সময়ে এই ধরনের আনন্দ উৎসব আমাদের মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়। পড়াশোনার মাঝেই প্রতিবছর ঈদুল ফিতর আমাদের জীবনে নতুন আমেজ নিয়ে আসতো কিন্তু করোনার থাবা এ খুশি ম্লান করে রেখেছে।
তাই এই ঈদ আমরা জনসমাগম এড়িয়ে চলে নিজেদের এবং প্রিয়জনকে সুরক্ষিত করার মাধ্যমে পালন করতে পারি। এছাড়া নিজ নিজ অবস্থানে থেকে হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরিবারের মানুষের সাথে পালন হোক এবারের ঈদ।"
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী যোবায়ের ইবনে আলী ক্যাম্পাসলাইভকে জানান, "ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। মুসলিমদের জন্য দুটো ঈদ। দুটো ঈদে আনন্দ করার বাইরে আরেকটি বিষয় আছে সেটি হচ্ছে দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানো। সামনে ঈদুল ফিতর।
ত্রিশ দিন রোজা রাখার পর গরীব দুঃখীদের প্রাপ্য ফিতরা দিয়ে এবং আনন্দ ভাগাভাগি করাই ঈদুল ফিতরের শিক্ষা হোক। ঈদের আনন্দের জোয়ারে মুছে যাক গ্লানি দূর হোক মহামারী। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এটাই ফরিয়াদ।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. শাহিন রানা ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, "ইসলাম ধর্মের প্রধান দুটি উৎসবের প্রথমটি আমাদের সামনে উপস্থিত। তাই একে ঘিরে আমাদের মাঝে নানা রঙিন ভাবনা, পরিকল্পনা চলতে থাকে। অবশ্য ভবিতব্য যা কিছু আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকেনা তা কখনো আমাদের পরিকল্পনা বৃত্তে সীমাবদ্ধ থাকেনা, সে মাফিক হয়না। তবুও নিশ্চিত ঘটনা ঘিরে আমাদের ভাবনা-পরিকল্পনা আবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু আনন্দটা যেন বয়সের সমানুপাতে হ্রাস পাচ্ছে।
যান্ত্রিক নির্ভরতা আমাদের সহজাত আনন্দকে শুষে নিচ্ছে। ছোটকালে যান্ত্রিকতার কলুষতা থেকে পাক ছিলাম বলেই হয়তো আনন্দটা বেশি হতো। তাছাড়া বয়সের সাথেসাথে চারিত্রিক দৃঢ়তা আসে, গাম্ভীর্যের ভূত চেপে বসে। শুভেচ্ছা বিনিময়, আত্মীয়দের খোঁজ খবর নেওয়াসহ ঈদের যাবতীয় সৌন্দর্যকে ফর্মালিটি, অযাচিত ভেবে বসে। আমার মনে হয় ম্যাচিউরিটি আমাদের হাসতে বাঁধা দেয়। আনন্দকে সীমিত করে সেই ম্যাচিউরিটি না আসাই ভালো।
এদিকে গতবছরের ঈদুল ফিতরের মতো এবারো আমাদের মাঝে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের প্রকোপের তীব্রতা বিরাজমান। তাই গতবছরের চেয়ে ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা নেই। সেই একই স্লোগান 'Stay Home, Stay Safe'। অবশ্য ঈদে ঘর থেকে বাইরে না যেতে পারাটাই বরং মানসিক প্রশান্তি দেয়না। মানসিক শান্তি মাঝেমধ্যে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
করোনা পরিস্থিতিতে আগের ঈদের চেয়ে বর্তমানের ঈদে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঈদের প্রধান আনন্দগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। কোলাকুলি করা, একসাথে বাইরে ঘুরাঘুরি করা এসব থেকে আমাদের বিরত থাকতে হচ্ছে।
অন্যদিকে লকডাউনসহ নানা কারণে খেটে খাওয়া মানুষদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাদের আয় রোজগারের দরজাগুলো বন্ধ। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলে আনন্দ বরং বাড়ে। আমরা কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী গতবছর করোনার প্রথম আঘাতের সময় 'একটুখানি মানবতা' নামে একটা সংগঠনের যাত্রা শুরু করি। সারাবছর সক্রিয় কর্মকান্ডের পর এই ঈদেও আমরা অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমাদের সকলের উচিত, করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারের জন্য জীবন বিপন্ন করে বাইরে খাটতে যাওয়া কর্মক্ষম, অক্ষম, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের মাঝে ঈদের আনন্দটুকু ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের নিজেদের ঈদকে সার্থক, পরিপূর্ণ করে তোলা।"
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার সোমা ক্যাম্পাসলাইভকে জানান, "শৈশবের স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ালে একটা রঙচঙে ঈদ ভেসে উঠে। মেহেদী রাঙা হাত, নতুন জামা-জুতো আর সালামীতে পাওয়া কড়কড়ে নোটগুলো, ঘুরে বেড়ানোর ঈদগুলো রূপকথার মতো সুন্দর ছিলো। বড়ো হলে সবকিছু কেমন পানসে হয়ে যায়, ঈদের আহ্লাদেরাও ছুটি নেয়। এখন ঈদ মানে গোটা দিন গল্পের বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া।
করোনাকালীন ঈদের আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। করোনা ছাড়া ঈদ যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। মানুষ দিব্যি শপিং করে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতোই বাঁকা চাঁদ নিয়ে ঈদ আসবে। বন্ধুর বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষায় কোন ব্যাঘাত ঘটছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানছে ক'জন?
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার করোনার কারণে ঈদ করতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না, অসুবিধে হচ্ছে শিক্ষাজীবন নিয়ে, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে৷ শিক্ষার্থী পরিচয়টাই এখন রসিকতা মনে হয়।"
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফায়েজুর রহমান ক্যাম্পাসলাইভকে জানান, "প্রতিবার যেমন খুশির আমেজে ঈদ উদযাপন করা যায়, এবারও তেমনি করা যাবে। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে এবার আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়ার সুযোগ নেই। মূলত শিক্ষার্থীরা ঈদে ঘুরে বেড়ানোটা মিস করবে। তবুও এই ভার্চুয়াল জগতে অনলাইনে বন্ধুদের সাথে মিট করা যাবে। তবে করোনাকালীন ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়টি হচ্ছে ঈদের এই খুশির দিনে পরিবারের সবাই সারাদিন একসাথে কাটানো যাবে।
লকডাউন থাকলেও আশেপাশের প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘুরাঘুরি হবেই, যা ঈদের আনন্দকে কিছুটা হলেও বাড়িয়ে তুলবে। তবে ব্যতিক্রমী ব্যাপারটা হচ্ছে, আগে যেমন ঈদের ছুটির জন্য সাধারণ স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি বন্ধের কারণে একটা অন্যরকম আমেজ থাকতো, যা ঈদের আনন্দকে কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিতো, বর্তমানে লকডাউনে সেই আমেজটা থাকবে না। সর্বোপরি বলা যায়, ঘুরাঘুরি কম হলেও রমজানের সিয়াম সাধনা ও ঈদের দিনের খুশি নিয়ে ঈদটা আনন্দময়ই হবে।"
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ ফুড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাজনিম তাকি ক্যাম্পাসলাইভকে জানিয়েছেন, "করোনাকালীন সময়ে আগের মতো আর ঈদ উদযাপন করা হয় না। গত দুবছর থেকে ঈদ আমার কাছে একই রকম। থাকছে না আগের মতো খুশি, বাড়িতে আসছে না কোনো আত্মীয়। পরিবারের সাথে কোথাও ঘুরতে যাবো সেটারও সুযোগ নেই।
যদিও পরিবারের সাথে অনেক সময় কাটাতে পারছি কিন্তু আগের মতো আনন্দটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। আশেপাশে চোখ দিতেই দেখি হাজারো নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া অসহায় মানুষ, অনাথ পথ শিশু। তাদের থাকছে না পড়নের কাপড়, পারছে না দুবেলা খেতে। চারদিকে এসব দেখে চোখ, মুখ আরো ভার হয়ে যায়। এভাবে তো আর ঈদ খুশিতে কাটানো যায় না। যেখানে মানসিক শান্তিটাই নেই, সেখানে ঈদের খুশি কোথায়!"
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, "ঈদ মানেই আনন্দ। ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ খুশিতে ঈদ উদযাপন করে আসছি৷ তবে করোনার প্রকোপে সমগ্র বিশ্বই বিপর্যস্ত। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানা ও নিজের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
গত বছরের ন্যায় এবার পরিস্থিতি সংকটাপন্ন। এবারের ঈদে বিশেষ কোন পরিকল্পনা নেই। বরাবরের মতোই অনেক বন্ধুর বাসায় ইতিমধ্যে দাওয়াত পেয়েছি। তবে পরিবারের সবার সাথে হাসি মুখে ঈদের দিনটি কাটাতে চাই।"
ঢাকা, ১৪ মে (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমজেড
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: