শান্তনা চৌধুরী, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি: প্রবাল দ্বীপ বাঁচান। সেন্টমার্টিন বাঁচান। এমন দাবী আজ ওই এলাকাসহ পর্যটকদের। সকলের দাবী একটাই এই দ্বীপ বাঁচাতে সরকারী সহায়তা দরকার। পর্যটন শিল্পকে দুনিয়ার সামনে তুরে ধরতেই এই প্রবাল পাথর সম্মলিত দ্বীপটি বাঁচাতে হবে। পশ্চিমাংশের ভাঙনের চিত্র এখন ত্রমেই স্পস্ট হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নয়, পূর্ণিমার জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে কয়েকটি বসতঘর।
এলাকাবাসীর অভিযোগ মাত্রাতিরিক্ত পর্যটক, দূষণ, একের পর এক বহুতল ভবন নির্মাণ আর নানা রকম পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।
এসবের ফলে প্রকৃতি এখন যেন ‘প্রতিশোধ’ নিতে শুরু করেছে। প্রতিটি পূর্ণিমার জোয়ারেই দ্বীপের কিছু না কিছু অংশ ভেঙে যাচ্ছে।
মানুষের উৎপাতে সামুদ্রিক কাছিমগুলো আর আগের মতো ডিম দিতে আসছে না। খাদ্য সঙ্কটে হারিয়ে যাচ্ছে পাখিসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো। দূষণের কারণে মরে যাচ্ছে প্রবাল। সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক অন্য সব অবস্থা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। এ নিয়ে এখন স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্বিগ্ন।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভেঙে যাচ্ছে। দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তর দিকে বেড়িবাঁধের মতো বালুর উঁচু টিলাগুলো এখন একটিও নেই। গত এক বছরের মধ্যে সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে এসব টিলা মিশে গেছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় কোমেনের আঘাতে ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে দ্বীপের সুরক্ষা লতা তথা কেয়াবন ও নিসিন্দা লতা। দু-চার বছরের মধ্যে ভাঙন তীব্র হয়েছে এবং অনেক এলাকা ভেঙে গেছে।
ক্রমেই পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তর দিকের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। দ্বীপের পশ্চিম দিকের নজরুলপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ছিদ্দিক ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, গত পূর্ণিমার প্রবল জোয়ারে আমার বসতভিটার একটি অংশ ভেঙে গেছে। সেই সাথে চলে গেছে প্রায় ৪০ বছরের পুরনো ছয়টি নারকেলগাছ। এখন ভয় হচ্ছে আগামী বর্ষায় ভিটার বাকি অংশটুকু রক্ষা করা যাবে কি না।
দ্বীপের বৃহত্তর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা ও সেন্টমার্টিন তাবলিগ জামায়াতের আমির মাস্টার শামসুল ইসলাম (৬০) ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, আমার বাবার জন্ম এই দ্বীপে।
পুরুষানুক্রমে আমরা এ দ্বীপে বাস করছি। বর্তমানে সেন্টমার্টিনে যে অত্যাচার চলছে তাতে আমরা শঙ্কিত। আমাদের মনে হচ্ছে দ্বীপের ওপর এই অত্যাচারের কারণে আল্লাহ এ দ্বীপ নিয়ে যাবেন। দ্বীপ হয়তো চিরতরে বিলুপ্ত না হলেও অচিরেই সেন্টমার্টিন জোয়ারভাটায় তলিয়ে যাবে।
লম্বায় ৩.৩৭ কিলোমিটার দ্বীপের ছেরাদিয়ায় কোনো জনবসতি নেই। গলাচিপা থেকে উত্তর দিকে জনবসতি সব। ১৮৯২ সালের (সিএস) জরিপে সেন্টমার্টিনের জমির পরিমাণ ছিল ৮০১.৮৬ একর এবং তা ছিল মাত্র ১২ ব্যক্তির নামে। ১৯২৯ সালে (আরএস) জরিপে ভূমি কিছুটা বেড়ে যায় এবং মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ৪৯ ব্যক্তির নামে ওই সময় ৮২৩.৮৮ একর জমি রেকর্ড হয়।
১৯৭২ সালের (বিএস) জরিপে ৯৭১ জনের নামে পাওয়া যায় ৮৩৫.৮০ একর জমি। কিন্তু বর্তমানে সার্ভে হলে জমির পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে কম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মওলানা ফিরোজ খানসহ অনেকে।
দ্বীপের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা আবদুর রহিম জেহাদী ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, উত্তর দিকে কবরস্থানের অনেক অংশ এখন সাগরে তলিয়ে গেছে। তার ভিটাবাড়ির অনেক জায়গাও সাগরে হারিয়ে গেছে। রহিম জেহাদী আরো বলেন, বাকি অংশটুকু বালুর বস্তা, পাথর দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু সর্বোপরি দ্বীপ নিয়ে সবাই শঙ্কিত।
কক্সবাজারের পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, দ্বীপ যেভাবে ভাঙনের শিকার হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে দ্বীপে পরিবেশবিরোধী কাজকর্মের জন্য প্রকৃতিই প্রতিশোধ নিচ্ছে। তার মতে, ভাটার সময় দ্বীপের আয়তন ৮ কিলোমিটারের কাছাকাছি হতে পারে কিন্তু জোয়ার এলে দ্বীপের আয়তন হয় ৫ কিলোমিটার।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রথম এসএসসি পাস করা ব্যক্তি মাস্টার আবদুর রহমান ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, হাজার হাজার পর্যটক ও শতাধিক আবাসিক হোটেলের (পাকা স্থাপনা) ভারে ন্যুব্জ সেন্টমার্টিন।
দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে পর্যটকের আগমন সীমিত করতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় দ্বীপের সব মানুষ সরিয়ে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, আমার দেখা মতে আগে দ্বীপের চার দিকে বিভিন্ন গাছের বীজ ও ফল জোয়ারের পানিতে ভেসে আসত। এসব বীজ ও ফল থেকে গাছ হতো। এখন মানুষের অত্যাচারে বীজ ভেসে আসে না, গাছ তথা লতাপাতাও গজাতে পারে না।
সেন্টমার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ খান দ্বীপ ভেঙে যাওয়ার অন্য সব কারণের সাথে একমত পোষণ করে ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, দ্বীপের ভেতরে ইনানী খাল রক্ষা করা না গেলে দ্বীপ থাকবে না। ২০০৪ সাল থেকে ইনানী খালের ভাঙন রোধ করার জন্য বিধ্বস্ত স্লুইচ গেটটি পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছি। এটি এখনো সংস্কার অথবা পুনর্নির্মাণ কোনোটিই হয়নি।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘নেকম’ কক্সবাজার অঞ্চলের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ শফিকুর রহমান ভাঙন প্রসঙ্গে ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, ‘লম্বায় দ্বীপ খুব বেশি কমছে না, কিন্তু পাশে বেশ কমে যাচ্ছে’।
জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম শরীফ ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, ‘আমি ১৯৮৭ সালে প্রথম সেন্টমার্টিন যাই। ওই সময় আমি দ্বীপে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট তথা বাইন গাছ দেখেছি। এখন নেই। দ্বীপের দক্ষিণে কিছু বাইন গাছ হয়তো থাকতে পারে। তা ছাড়া আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ন্যাচারাল প্রটেকশন ছিল। ছিল কেয়া গাছের বাউন্ডারি। গত কয়েক বছরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় সব ন্যাচারাল প্রটেকশন ধ্বংস করায়ই সেন্টমার্টিনের উত্তর ও পশ্চিম অংশ ভেঙে যাচ্ছে।
ন্যাচারাল প্রটেকশন হিসেবে ছিল বড় বড় পাথর, ছিল কেয়াবন, নিসিন্দা লতা ও গাঙ্গ লতা। কেয়াগাছ কেটে স্থানীয়রা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। পাথর তুলে বিক্রি করেছে পাকা স্থাপনার মালিকদের কাছে। গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল। চরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে হাঁটাহাঁটিতে নিসিন্দা লতা ও গাঙ্গ লতা বেড়ে উঠতে পারছে না। শীত মওসুমে এসব লতার সাথে বালু জমে উঁচু টিলা হতো, কিন্তু এখন মানুষের বাধায় হতে পারছে না।
তার মতে, বর্তমানে সেন্টমার্টিন তার লোডিং ক্যাপাসিটির বাইরে চলে গেছে। এ ছাড়া গ্রিন হাউজ এফেক্টে সি লেভেল তো কিছুটা বেড়েছে। এসব কারণে সেন্টমার্টিন ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
তার মতে, সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সুষ্ঠু নীতিমালা করে এর বাস্তবায়ন করতে হবে। নিয়ন্ত্রিত পর্যটন চালু করতে হবে। বাড়াতে হবে মানুষের মাঝে সচেতনতা। নইলে দ্বীপ রক্ষা করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
ভিডিও:
ঢাকা, ২৪ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)// এএসটি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: