Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিটেকের ভাস্কর্য

প্রকাশিত: ১১ নভেম্বার ২০১৬, ২১:৩৫

বিটেক লাইভ: ভাস্কর্যে ফুটে ওঠে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সময়, সমাজ জীবনের পুরোনো সংস্কৃতি। প্রতিফলিত হয় স্বপ্ন, আকাঙ্খা, বেদনা বা গৌরবের। জাগ্রত হয় চেতনাবোধ। সিমেন্ট, চুনাপাথর, কংক্রিটের মিশেলে গড়া ভাস্কর্যগুলো যেন আমাদের জীবনের কথা বলে।

তাইতো তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন বার্তা পৌঁছে দিতে দেশের বিভিন্ন শহর থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনগুলোয় নির্মাণ করা হয়েছে মনকাড়া ও স্মৃতিবিজড়িত ভাস্কর্য এবং ম্যুরাল। পিছিয়ে নেই টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বিটেক) ক্যাম্পাসও। এই বিদ্যাপীঠেও রয়েছে নজরকাড়া স্থাপত্য। তন্মধ্যে ছয়দফা, চরকা, বিজয় একাত্তর অন্যতম।

প্রায় সবগুলো ভাস্কর্যের ডিজাইনার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ও ভাস্কর্যশিল্পী সৈয়দ সাইফুল কবীর রঞ্জু।

চলুন এক নজরে জেনে নেয়া যাক ভাস্কর্যগুলোকে-

১. স্থাপত্যকর্ম "ছয়দফা"

ছয় দফা বাঙালীর "মুক্তির সনদ"। এর মাধ্যমে শোষিত বাঙালী জাতি পেয়েছিল নতুন দিক নির্দেশনা। পেয়েছিল পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের সংগ্রামী পথের নিশানা। বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত ঐতিহাসিক ৬ দফাকে সম্মান জানিয়ে তাই বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বিটেক) নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলা "ছয়দফা"। এর নকশা প্রণয়ন করেন স্থাপত্য অধিদফতরের সহকারী স্থপতি সিরাজী তারেকুল ইসলাম আর টেরাকোটার নকশা করেন ভাস্কর সৈয়দ সাইফুল কবীর রঞ্জু।

২০১২ সালে নির্মিত ষড়ভুজাকৃতির ছয়দফা চত্বরটি ক্যাম্পাসের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে নয়নাভিরাম এই স্থাপনাটি। এর মূল বেদীর আয়তন প্রায় ১২০ ফুট বাই ১২০ ফুট। ভূমি থেকে আড়াই ফুট উঁচু, মাঝ খানটা পুরো উন্মুক্ত স্থাপত্যটি ৩০ টি স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। ছয়দফায় রয়েছে অপরুপ টেরাকোটার কাজ। ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ৬ টি দফা অত্যন্ত সুন্দরভাবে টেরাকোটায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

মুক্তমঞ্চ ছয়দফা চত্বর ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। শুধু অনুষ্ঠানাদিই নয়, অবসরের প্রিয় মুহুর্তগুলো বর্ণিল ছটায় কাটানোর জন্যে শিক্ষার্থীদের প্রিয় জায়গা "ছয়দফা"।
নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে স্থাপনাটি এক অনন্য নিদর্শন। ছয়টি বাহুতে ৬ টি দফা ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা এরকম স্থাপত্যের মাধ্যমে শুধু বিটেকের শিক্ষার্থীরাই নয় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং এর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে জানতে পারছে। বুকে ধারণ করছে দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা।


২. ঐতিহ্যের স্মারক "চরকা"

আবহমানকাল থেকেই বাংলার তাঁতশিল্পের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে চরকা। এই চরকাকে অবলম্বন করেই প্রাচীনকালে তাঁতশিল্পের সাথে জড়িতরা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতো। অধুনা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ মেশিনের কাছে হার মেনে এই যন্ত্রটি বিলুপ্তপ্রায়। শহর থেকে তো বটেই আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও এর দেখা মেলা ভার।

বাংলার হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে "চরকা"। এর কারিগর ভাস্কর সৈয়দ সাইফুল কবীর রঞ্জু। প্রতিষ্ঠানের মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে ভাস্কর্যটিকে। শ্বেতবর্ণের ভাস্কর্যটি বেদিসহ ১৭ ফুট বাই ১২ ফুট জায়গার ওপর নির্মিত। চরকার অংশটি মূল ভিত্তি থেকে ৫ ফুট উপরে।

ভাস্কর্যের বিষয়বস্তুতে শাশ্বত বাংলার চরকায় সুতা কাটারত এক রমনী এবং সুতা ভরার নলী দিয়ে সাহায্যকারী বালকের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চে পূর্ণোদ্যমে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় একই বছরের অক্টোবর মাসে।

অতীতে তাঁতবস্ত্র তৈরির জন্যে প্রধান এই যন্ত্রটির প্রচলন ছিল। হস্তচালিত তাঁতশিল্পের স্বর্ণযুগে তো বটেই নব্বই দশকের দিকেও বাংলার প্রায় প্রত্যেক ঘরে এই বুনন যন্ত্রটি ছিল। বয়নকারীরা ব্যবহার্য শাড়ি, লুঙ্গিসহ যাবতীয় কাপড় প্রস্তুতে যন্ত্রটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ফলে এটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

তাঁত শিল্পের ঘাঁটি বলে পরিচিত টাঙ্গাইল। এই শিল্পের সাথে চরকা জড়িয়ে থাকায় এরকম ভাস্কর্য যেমন তাঁতী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে তেমনি জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

৩. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ "বিজয় একাত্তর"

১৯৭১ সালের মহান মুক্তি সংগ্রামে বাংলার সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা চেতনা স্মরণে বিটেকে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ "বিজয় একাত্তর"। ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চ ছয়দফার কৌণিক বিপরীত দূরত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এটি। এই স্থাপনাটিতেও ছোঁয়া লেগেছে ভাস্কর্যশিল্পী সৈয়দ সাইফুল কবীর রঞ্জুর সুনিপুণ হাতের।

"বিজয় একাত্তর" এর কেন্দ্রে রয়েছে রাইফেল-পতাকা হাতে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্টেনশিল কাটের নজরকাড়া বিপ্লবী ভঙ্গিমা। স্মৃতিস্তম্ভের ডানপার্শ্বে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও সর্বস্বত্যাগী সংগ্রামী মহানেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত ভাষণের কারুকার্য খচিত ফলক। আর বামপার্শ্বে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ সময়কালের টেরোকোটায় ফুটিয়ে তোলা সুচারু নকশা।

স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে ও বেদীতে আঁকা হয়েছে কালো রঙয়ের বর্ডার যা ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের আত্মত্যাগ, দুঃখ ও শোকের প্রতীক আর স্টেনশিল কাটের বীর সৈনিকের নিচে শ্বেতবর্ণের মার্বেল পাথরে লাল-সবুজ হরফে লেখা "বিজয় একাত্তর" শান্তি ও দেশের পতাকা প্রতিনিধিত্বকারক রুপে আবির্ভূত। আধুনিক দৃষ্টিনন্দন এ স্থাপত্যটির সম্পূর্ণ বেদীর বাইরের দৈর্ঘ্য ৭১ ফুট, ভিতরের দৈর্ঘ্য ৬৯ ফুট এবং প্রস্থ ৫২ ফুট।

যেটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান ও ভাষা আন্দোলন সময়কালের পরিচায়ক। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর সাথে মিল রেখে মূল বেদীর পরিমাপ রাখা হয়েছে ২১ ফুট। টেরোকোটার অংশ ৯ ফুট। স্থাপনাটির উচ্চতা ২৩ ফুট যার সামনের সাদা স্তম্ভের অংশটুকু ৭ ফুট আর স্টেনশিল কাটের বীর সৈনিকের অংশটুকু ১৬ ফুট। সংখ্যার হিসেবে যেগুলো যুদ্ধের সময়কাল, ৭ মার্চ ও বিজয় দিবসের মতো অম্লান স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন "বিজয় একাত্তর"। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এবং শেষ হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে বীর সৈনিক বিজয়ীর বেশে নির্ভীক প্রহরীর মতো স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলায় বীর সৈনিকের উপর র্যাডিশ আলোর প্রক্ষেপণ স্থাপত্যজুড়ে এক ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে স্থাপিত এই "বিজয় একাত্তর" আলোকিত করে রেখেছে ক্যাম্পাসকে। আর প্রতি ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছে স্বোপার্জিত স্বাধীনতার গৌরবময় স্মৃতির কথা। তাইতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ক্যাম্পাসে ছুটে আসে স্থাপত্যটি একনজর দেখার জন্যে ।


ঢাকা, ১১, নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//আইএইচ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ