Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০
teletalk.com.bd
thecitybank.com

মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় আবেদ আহমেদের গল্প

প্রকাশিত: ৮ জানুয়ারী ২০২২, ০৭:৪৭

আশিকুজ্জামান: একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। ভারতে যেতে যে প্রধান রুট গুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল আড়িয়াল খাঁ ও ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত নরসিংদী জেলার বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল ব্যবহার করে ভারতের আগরতলায় পৌঁছানো।

রাজধানী ঢাকার অদূরে অবস্থিত নরসিংদী জেলার বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল নদী-খাল-জলা এবং ঝোপ-জঙ্গল-গাছপালা ঘেরা হওয়ায় ভৌগোলিকভাবে বেশ দুর্গম ছিল। ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলের মানুষ যখন চরম অনিরাপত্তা ও জীবন শঙ্কায় ছিল তখন নিরাপদে ভারতের আগরতলায় যাওয়ার রাস্তা হিসেবে এই এলাকা ব্যবহার করত।

ত্রিপুরার আগরতলায় ২ নম্বর ও ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর অবস্থিত হওয়ায় এবং এর নিকটবর্তী অঞ্চল হিসেবে এই এলাকা শত্রুমুক্ত রাখা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যতম দায়িত্ব ও নির্দেশনা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই সেক্টর দুটির আওতাভুক্ত এলাকার লোকজন অস্ত্র-গোলাবারুদ ও যুদ্ধের রসদ আনা-নেওয়ার জন্য এবং শরণার্থীরা এই এলাকাকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করত।

একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বেলাবো-মনোহরদী অঞ্চল দিয়ে ভারতের আগরতলায় চলাচলের পথকে শত্রুমুক্ত রাখাতে ভূমিকা রাখে এফএফ গেরিলা বাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনীর একটি দল। এফএফ গেরিলা এবং নিয়মিত—এই দুই বাহিনীর সমন্বয়ে এই এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়। নিয়মিত বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআরের কাজী আকমল ও কাজী ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়। আর এফএফ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আহমেদ।

ইনকা সাম্রাজ্যের বার্তা প্রেরণ পদ্ধতির মতো তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এই এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিলেন। বেলাব থানার বিন্নাবাইদ ইউনিয়নে জন্ম আবেদ আহমেদ রাজনীতিরসূত্রে এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই নখদর্পণে ছিলেন। ফলে গেরিলা যুদ্ধে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করেন।

যুদ্ধদিনের মনোহরদী-বেলাবো কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সে সময় বলা হতো এটি “বাংলাদেশের আগরতলা”। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশিরা যেমন নিরাপদ অনুভব করত, যুদ্ধে তাড়া খাওয়া বিপন্ন ব্যক্তিরা ঠিক তেমনটিই বোধ করত এই বেলাব-মনোহরদী এলাকায় পৌঁছে। ঢাকা-গাজীপুর-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি জেলার লোকজন কখনো নৌকায়-কখনো পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুর, নবীনগর, কসবার মনতলা-মনিহন্দ ও ভারতের চারিপাড়া এবং সরাইলের আজবপুর, নাসিরনগর, হরিণবেড় এবং মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া-কাতলামারা ইত্যাদি সীমান্ত পথে পাড়ি দিত। এই রুটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, আগরতলায় অবস্থিত বিভিন্ন ক্যাম্পে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাওয়া তরুণ-যুবা ও শরণার্থীদের নিরাপদে পৌঁছার রাস্তা নির্বিঘ্ন রাখা, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি আদান-প্রদান।

এফএফ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার আবেদ আহমেদ এবং নিয়মিত বাহিনীর কাজী আকমল ও কাজী ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এই এলাকায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো রামপুর, মাধুপুর কাচারী, মনোহরদী সদর পাকবাহিনীর ঘাঁটি, দশদোনা, বিলাগী এবং পোড়াদিয়া থেকে চরসিন্দুর পর্যন্ত পলায়ন পর শত্রুসেনাদের মোকাবেলা ও পিছু ধাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্রাঞ্চলের নিরাপত্তা বিবেচনায় মানুষের মুখে মুখে এই এলাকা বাংলাদেশের “আগরতলা” নামে খ্যাত ছিল।

যুদ্ধের সময় তরুণ আবেদ আহমেদ প্রথমে ভারতের আগরতলার জয়নগর স্কুল ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টারে প্রেরিত হন। সেখানে নিয়মিত যুদ্ধের জেনারেল ট্রেনিং নেন। এখানে অবস্থানকালীন ৫টি কোম্পানি থেকে বাছাই করা শিক্ষিত-মেধাবী তরুণ নিয়ে আলাদা করে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতেন মেজর আব্রাহাম। অম্পিনগরে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি চূড়ান্ত গেরিলা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন মেলাঘরে মেজর এটিএম হায়দারের নেতৃত্বে।

প্রশিক্ষণে যাতে প্রশিক্ষক বাড়তি সুবিধা না দেয়, সে জন্য নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। অসামান্য দক্ষতা ও গেরিলা যুদ্ধের কলা-কৌশল নিপুণভাবে আয়ত্ত করায় ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান কমান্ডো মেজর এটিএম হায়দারের নজরে আসেন তিনি। দায়িত্ব পান এফএফ গেরিলা অধিনায়ক হিসেবে বেলাবো-মনোহরদী ও সংলগ্ন গেরিলা অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত রাখার।


রাজনীতিতে আসা যেভাবে: ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। মানিকগঞ্জ সরকারি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৬২ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন। এখানে তখন দেশব্যাপী চলা ৬২ ’র হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। সে সময়ে তিনি বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর হাত ধরে ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি নেন।

তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ’র বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। তিনি মোনায়েম-বিরোধী ছাত্রআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ৬৬ ’র ছয় দফা আন্দোলনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তিনি একসঙ্গে নেতৃত্ব দেন। এই কলেজের ১৯৬৫-৬৬ সালে ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং পরবর্তী ৬৬-৬৭ সালের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আবেদ আহমেদ।

বিএসসি পড়াকালীন ৬৮ ’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে আইয়ুব-সমর্থক বিডি মেম্বারদের জোর পূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এ আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি মামলার আসামি হন। আর এই মামলার জামিন বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই প্রথম তিনি বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ এবং স্নেহস্পর্শ লাভ করেন। ১৯৭০ সালে তরুণ এই ছাত্রনেতা মনোহরদী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

যুদ্ধে আসা: ১৯৬৯-৭০ এ চলে আসেন তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলে নিজ এলাকায়। ৭০’র জাতীয় নির্বাচনে তিনি মনোহরদী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অত্র অঞ্চলে মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধের সময় নিজের রাজনৈতিক পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন। চাইলেই তিনি এমপিএ-এমএনএ’দের সঙ্গে থেকে দাপ্তরিক কোনো কাজে যুক্ত হতে পারতেন।

কিন্তু তাঁর মনে ছিল সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার অটল প্রত্যয়। এমপিএ ফকির সাহাব্বুদ্দিন (প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল), অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ভূইয়া এমএনএ প্রমুখ কংগ্রেস ভবনে থাকার জন্য চাপাচাপি করা সত্ত্বেও তিনি পার্শ্ববর্তী জয়নগর স্কুল ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন।

চূড়ান্ত গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দারের কাছ থেকে। নিজের যোগ্যতায় নজর কেড়েছেন সেক্টর প্রধানের। তার সঙ্গে স্মৃতির গল্পও রয়েছে অনেক।

ভারতে প্রশিক্ষণকালীন সময়ের কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ছাত্ররাজনীতি করার সময়ই আমার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত স্বাধীনতা-বিপ্লবের ইতিহাস পাঠ করা ছিল। মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবে, সেটা ছিল অচিন্তনীয়। তাই দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের কৌশল হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল।

প্রশিক্ষণ শেষে বেলাবো-মনোহরদী অঞ্চলের এফএফ গেরিলাবাহিনীর দায়িত্ব পান তিনি। ভারতের আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রাককালে, এখানে অবস্থিত নিয়মিত বাহিনীর প্লাটুন সরাসরি ‘এস’ ফোর্সে দপ্তরে যুক্ত হয়। এ সময় এই এলাকার সার্বিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মনোহরদী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থানরত সকল মিলিটারি ফোর্স (এমএফ) ও ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ) কে তাঁর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রশাসনিক কার্যভার নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এফএফ গেরিলা বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মোট আটটি গ্রুপে প্রায় পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাঁর নেতৃত্বে। তাঁর দুটি গ্রুপের সম্মুখ যুদ্ধ “বিলাগী” ও “দশদোনা”র খবর সে সময় আকাশবাণী রেডিওতে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। বিলাগী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩টি সৈন্য ভর্তি গাড়ির ২টি উল্টে যায় এবং ১৯ জন নিহত হয়।

উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ বর্ণনা: মনোহরদী থানায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প মুক্ত করা ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি সম্মুখ যুদ্ধ। একাত্তরের অক্টোবরের ২১ তারিখে তিনি ও কাজী আকমল ও কাজী ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের যৌথ পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনায় এই ক্যাম্পে চূড়ান্ত আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধের অন্যতম সফলতা ছিল চারজন পাকিস্তানি সৈন্যকে কমান্ডার সুবেদার জুলফিকারকে জীবিত আটক করা এবং সহযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হওয়া।

এ ছাড়া ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ভৈরব থানা ঘাঁটির পতন হলে বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টগামী পলায়নরত পাক সেনাদের প্রতিরোধে তিনি সরাসরি মুখোমুখি যুদ্ধে একজন আহত সৈন্যকে আটক করতে সমর্থ হন। পাশাপাশি তাদের চরসিন্দুর পর্যন্ত ধাওয়া করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপের মাধ্যমে ১৭ জনকে আটকে ভূমিকা রাখেন।

১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর ভর্মা হেলিকপ্টারে নরসিংদী সদরে অবতরণ করলে তিনি জ্বালানিসহ গাড়ির ব্যবস্থা করে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে সহায়তা করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ মো. আরিফুল আবেদ।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণের তাগিদ বিদ্যায়তনিক বা সাধারণ পরিসরে তেমন হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক জাতীয় ইতিহাস যেমন দরকার তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক পর্যায়ের ঘটনা ও ব্যক্তিবর্গের অবদানও লিপিবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের “আগরতলা” খ্যাত আড়িয়াল খাঁ-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত বেলাবো-মনোহরদী অঞ্চলকে যেকোনো মূল্যে শত্রুমুক্ত রাখার বিশেষ নির্দেশনা ছিল সেক্টর থেকে। এই মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া প্রয়োজন।

যুদ্ধের পরেও এলাকা রেখেছেন নিরাপদ: ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সবাই বাড়ি ফিরলেও তাঁর বাড়ি ফেরা হয় না। কারণ, স্বাধীন হওয়ার পরও প্রায় দেড় মাস পর্যন্ত তাঁকে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে এই এলাকার প্রথম সিও (ডেভ) সিও (রেভ), ওসিসহ অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ তাঁর হাতে যোগদানপত্র দিয়ে কার্যভার গ্রহণ করে।

পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে অস্ত্র জমা দেন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে সরবরাহকৃত ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র বিতরণ করেন। সিও (ডেভ) সিও (রেভ), ওসিসহ অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অত্র অঞ্চলের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা সহজ ছিল না। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি ও জনগণের জানমাল রক্ষার পাশাপাশি সরকারি সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। প্রশাসন ও পুলিশ দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা মূল্যের সার, পাটের গোদাম এবং শতাধিক শ্যালো ইঞ্জিনের ওয়্যারহাউস সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লুট করা লক্ষাধিক টাকা লুটেরাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত দিয়ে সততার অনন্য নজির গড়েছেন।

এই বীর মুক্তিযুদ্ধের বক্তব্য, যুদ্ধের সময় প্রায় প্রতি মাসেই আমাকে ওপারে সেক্টর দপ্তরে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ শেষে নতুন রিক্রুট হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে আনতে হতো। এময় আমার এলাকার সর্বশেষ যুদ্ধ-পরিস্থিতি রিপোর্ট আকারে পেশ করে নতুন কোনো নির্দেশনা থাকলে নিয়ে আসতাম। আমার অধীনস্থ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এবং সীমান্তে পাড় হওয়া লোকজন সেক্টর দপ্তর ও আগরতলায় গিয়ে এই এলাকাকে বাংলাদেশের “আগরতলা” বলে নামকরণ করে। মায়ের কোলে একজন শিশু যেমন নিরাপদ থাকে, আমারও মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিল বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলকে তেমন রাখা।

তাঁর অভিমান মুক্তিযোদ্ধার বর্তমান সংজ্ঞা ও তালিকাভুক্তি নিয়ে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৯ শব্দে “মুক্তিযোদ্ধা”কাদের বলা হবে, এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। অথচ তাঁর সংজ্ঞাকে উপেক্ষা করে এখন বিভিন্ন ফর্মুলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নিষ্পত্তি করা বিষয়ের এমন অবমাননা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ৯৪ নম্বর অধ্যাদেশে, ৭ আগস্ট প্রকাশিত গেজেটে “মুক্তিযোদ্ধা”র সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন এভাবে, “Freedom Fighter means any person who had served as a member any force engaged in the war of liberation but shall not include members of the Defence Services or the police or the Civil Armed Forces.”

তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বাস্তবায়নে জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।


লেখক:
শিক্ষার্থী,
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


ঢাকা, ০৭ জানুয়ারী (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ