আদীব মুমিন আরিফ : চায়ের দেশ সিলেট, পাহাড় ও ঝর্ণার দেশ সিলেট, তার চেয়ে বড় পরচিয় হল সিলেট জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ বিভাগ। সিলেটের প্রকৃতি যেমন বৈচিত্র্যময় আছে পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, ছরি, হাওড়, বাওড়, বিল ও বন তেমনি সিলেট বন্যপ্রাণি পাখি, প্রজাপতি, মাকড়সা ও মাছের জন্য বৈচিত্র্যময় সমাহার। সিলেট বিভাগে আছে সাতটি সংরক্ষিত বন ও বিল। এর মধ্যে লাউয়ারছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, বাইক্কাবিল, মাধবকুন্ড ইকোপার্ক ও রেমা-ক্যালেঙ্গা ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারি অন্যতম।
আর তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের (৪৩ তম আবর্তন) “প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য” বিষয়ক প্রতিবেদনের (শিক্ষা সফর ২০১৭) জন্য বৃহত্তর সিলেট বিভাগকে বেছে নেয়া হয়।
আমাদের সফর শুরু হয় ভোরে। যথা সময়ে বাস উপস্থিত থাকে ছাত্রদের বঙ্গবন্ধু হলের সামনে আমরা ছেলেরা একে একে চোখ ডলতে ডলতে উঠি বাসে যদিও রাতে ঘুমতে পারিনি কেউ ট্যুরের প্রস্তুতি ও বাড়তি আনন্দের জন্য। আমাদের শিক্ষক হাসান স্যার তিনিও বাসে উঠে আসন নেন আমাদের সাথে এরপর বাস চলে যায় ছাত্রীদের প্রীতিলতা হলের সামনে সেখানে মেয়েদের বাসে উঠার পর বাস ক্যাম্পাস ত্যাগ করে সরাসরি সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সকাল সাতটায় সূর্যমামা উকি দিল বাসের জানালায়। ততক্ষণে বাস ঢাকা ছেড়ে প্রবেশ করেছে অন্য জেলায় কুয়াশার চাদর খুলে রোদ পোহাচ্ছে ফসলের মাঠ, সবুজের জনপদ। এভাবে বাস এগিয়ে গেল আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে। এরপর বাস থেকে সকলে নেমে গোল হয়ে দাঁড়ালাম শিক্ষকদের চারদিকে প্রাথমিক আলোচনা কিভাবে বন ঘুরতে হয় বন্যপ্রাণিকে ডিস্টার্ব না করে।
প্রথমেই মুখ অফ,
দেখবো শুধু চোখে,
শুনবো মোরা কানে,
কথা হবে না মুখে ।
এরপর আমরা শিক্ষকের পিছনে পিছনে এগিয়ে গেলাম লাউয়াছড়া বনের ভিতর প্রথমেই সামনে পড়লো একদল বানর, আর একটু এগোতেই দেখলাম বানরের অন্য একটি প্রজাতি ‘উল্টা লেজী বানর” উল্টা লেজী বানরের লেজটি পিছনে উল্টা দিকে বাকিয়ে থাকে তাই এর নাম উল্টা লেজী বানর ইংরেজিতে যাকে বলে “পিগ টেইলড ম্যকাকা”। এরপর কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখা মিললো “মুখ পোড়া হনুমানের” মুখ পোড়া হনুমানের সমস্ত শরীর সাদা বা অন্য রং এর লোমে আবৃত হলেও এ বানরটির মুখ কালো আর তাই এর নাম মুখ পোড়া হনুমান। এরপর বনের ভিতর তই হাঁটি ততই দেখা মেলে নানা জাতের নানা প্রজাতির প্রাণি।
“কমন গার্ডেন লিজার্ড” যাকে আমরা বাংলায় বলি রক্তচোষা বা গিরগিটি, এর নাম রক্তচোষা হলেও এ মোটেও রক্ত পান করে না, তবে এ সরীসৃপটি যে আসলেই এর গায়ের রং পরিবর্তন করতে পারে তা বনে গিয়ে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। বনের আঁকা বাঁকা পথে হারিয়ে যাওয়া আর বানরের বাদরামি নিয়ে যায় অন্য লাউয়াছড়া বনে।
আমরা মোট পাঁচ প্রজাতির প্রাইমেট বর্গের প্রাণী দেখতে পাই। উপরে বর্ণিত তিন প্রকার ছাড়াও অন্য দুটি হল “চশমা পড়া হনুমান” এ হনুমানটির চোখের চারদিকে সাদা গোলাকার দাগ আছে যা দূর থেকে দেখতে চশমার মত মনে হয়। লাউয়াছড়া মানেই গিবনের জন্য বিশেষ স্থান।
যাকে দেখার জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়। এরা সাধারণত গাছের অনেক উপরে বসবাস করে আর কখনোই এরা মাটিতে নামে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে আমরা “ পাঁচটি গিবনের দেখা পাইে এর মধ্যে পুরুষ দুটি আর মেয়ে দুটি ও একটি মেয়ে বাচ্ছা গিবন। পুরুষ গিবনরে গায়ের লোম কলো আর মেয়ে গিবনের গায়ের রং সাদাটে ।এই সেই “উল্লুক গিবন” যকে দেখার সময় ছোটবেলার কথা মনে পড়েছে। খুব ছোটবেলায় যখন দুষ্টুমি করতাম নানা তখন আমাকে উল্লুক বলে বকা দিত আর আজ সেই উল্লুকের দেখা পেলাম।
গিবনরা আমাদের মানুষের মত একক পরিবার কেন্দ্রিক, দুই নারী-পুরুষ দম্পতি আর তাদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত হয় এক পরিবার। আবার আমাদের মত ছেলে বা মেয়ে বড় হলে তাকে গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বিচ্ছিন্ন গিবনটি আবার তার সঙ্গি খুজে নতুন করে সংসার শুরু করে।
এরপর আমাদের অভিযান “মাধবকুন্ড ইকোপার্ক” যেখানে সাধারণ দর্শনার্থীরা মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে যায়। আমরাও সেখানে জলপ্রপাতের স্বর্গীয় রূপ দর্শন করি। জলপ্রপাত বা ঝর্ণা দেখে আমরা আমাদের দুই দিনের বনে বনে পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটার সব কষ্ট ভুলে যাই। পাহাড়ে বা বনে ঘুরা আন্দের কিন্তু যখন আপনাকে বনে-বনে ঘুরে ক্লাশ করতে হয় তখন একটু হলে কষ্ট হয়। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত।
ভূমি থেকে যার উচ্চতা প্রায় ২০০ ফিট বা ৬১ মিটার। এখানেও আমরা নানা প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি দেখতে পাই।
এভাবেই নানা রকম বন্যপ্রাণি ও পাখপাখালি দেখে অনেক রোমাঞ্চকর স্মৃতি নিয়ে আমাদের শিক্ষাসফর শেষ হয়।
ঢাকা, ১৫ মার্চ (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমএইচ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: