ছাত্ররাজনীতি। শব্দটি হালে আলোচিত। সমালোচিত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের নানান ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এমনি ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। কিন্তু পরবর্তিতে নানা সুবিধাবাদী চক্র এই ছাত্র রাজনীতিকে করেছে কুলষিত। করেছে কালিমাযুক্ত। এই ছাত্র রাজনীতির নির্মমতার শিকার হয়েছেন অনেকেই। কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউবা তার পুরো জীবন হরিয়েছেন। সেসব পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়।
এসব ননান কারণে এখন প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি বন্ধ করা হবে ছাত্ররাজনীতি! নাকি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনকে আবদ্ধ রাখতে সবার মাঝে। তবে লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে কেউ কথা বলছেন না। এসব নানান বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন, তাদের মতামত নিয়েছেন আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) প্রতিনিধি
রেজওয়ান ইসলাম...
গত ৬ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেন বুয়েট ১৭ ব্যাচের ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। বুয়েটের শেরে বাংলা হলে এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে। আর এ মৃত্যুর পরই গুঞ্জন ওঠে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। শিক্ষার্থীদের দাবীর মুখে বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বুয়েট প্রশাসন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি এখন আদালতে গড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন এক আইনজীবি। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠেছে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) এর ছাত্র নেতৃবৃন্দদের সাথে। আসুন জেনে নেই তাদের বক্তব্য
মো. তরিকুল ইসলাম, বিদায়ী সভাপতি, ছাত্রলীগঃ
ছাত্রলীগ জবি শাখার বিদায়ী সভাপতি বলেছেন, “মাথা ব্যাথা করলে মাথা কেটে ফেলাটা কোন সমাধান হতে পারেনা।“ বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল ছাত্ররা। তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোন সমাধান হতে পারে না। বরং ছাত্র সংগঠন গুলো যেন তাদের ভুল শুধরে নিতে পারে সে বিষয়ে যার যার সংগঠনের হাই কমান্ডের নির্দেশনার প্রতি জোর প্রদান করেন তিনি।
গুটি কয়েক নেতা কর্মীর অপকর্মের দায় কখনোই সংগঠনের হতে পারে না। সে যে সংগঠনেরই হোক না কেন। ছাত্র সংগঠন গুলো ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করবে ,তারা যেন নিজের স্বার্থ নিয়ে কোন কাজ যেন না করে। তারা যখন সংগঠনের স্বার্থ না দেখে নিজ নিজ স্বার্থ দেখবে তখনি দেখা যাবে সংগঠনের নীতি বিরোধী কাজে তারা জড়িয়ে পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ছাত্র নেতারা শিক্ষকদের রাজনীতির শিকার বা শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নীতি বিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়েন। কাজেই শিক্ষকদের উচিত ছাত্র নেতাদেরকে প্রভাবিত না করে তাদের কে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করা।
তরিকুল ইসলাম বলেন, সংগঠনের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত নিজস্ব ''মাই ম্যান'' না খুজে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করা। এতে অনেকাংশে ছাত্র সংগঠনের নীতিবিরোধী কাজ কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি এটি স্বীকার করেন যে ছাত্র রাজনীতিতে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে আর নেতিবাচক পরিবর্তন গুলো শুধরে নিয়ে নতুন ভাবে আস্থাভাজন সংগঠন হওয়ার সময় এখনি।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নেতৃত্ব সংকটে পড়বে বলে তিনি মনে করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা যদি ব্যক্তি স্বার্থ দেখে নেতা নির্বাচন না করে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করে, তাহলেই কমে আসবে ছাত্র সংগঠনের নেতিবাচক কর্মকান্ড। সবশেষ তিনি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করে ছাত্র সংগঠন গুলোকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেন, এতে করে সংগঠন গুলোর উপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস পুনরায় ফিরে আসবে।
রফিকুল ইসলাম রফিক ,সভাপতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলঃ
ছাত্রদল জবি শাখার সভাপতি বলেছেন, একটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম পথ হলো ছাত্র রাজনীতি। আজকের ছাত্রনেতারাই আগামী দিনে দেশ পরিচালনা করবে । তাই, কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের অপকর্মের দায়ে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান হতে পারে না।
ছাত্র রাজনীতি না থাকলে আমরা বাংলা ভাষা পেতাম না। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, ৯০ এর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হতো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক অথবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, যেকোনো জায়গায় যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবার আগে ছাত্ররাই প্রতিবাদ করে। ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ছাত্র নেতারাই সবসময় সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাই ছাত্র রাজনীতি নয়, ছাত্রদের অপ রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
প্রসেঞ্জিত সরকার, সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টঃ
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের জবি সভাপতি বলেছেন, একটি মহল সুদূরপ্রসারী কোনো পরকিল্পনা বাস্তবায়নরে অসৎ উদ্দশ্যে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে একতরফা ও অবরিাম অপপ্রচার চালাচ্ছে। অতীতের মতো শাসক দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপর্কমকে ছাত্ররাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করে গোটা ছাত্রসমাজকে গণতান্ত্রকি অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্যে অপচষ্টো চালাচ্ছে।
শিক্ষা ও ছাত্রস্বার্থ-সংশ্লিস্ট ইস্যুগুলোর পাশাপাশি দেশ এবং জনগণরে স্বার্থে গুরুত্বর্পূণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যুতেও আমাদের দেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ বীরত্বর্পূণ ভূমিকা রয়েছে।
ছাত্র রাজনীতরি দুটি ধারা বিদ্যমান আছে ক্যাম্পাসগুলোতে। একটি ধারা যারা সন্ত্রাস চাঁদাবাজী নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে। আরেকটি ধারা যারা ছাত্রদের দাবীগুলো নিয়ে কাজ করে। এই সন্ত্রাসবাদী ছাত্ররাজনীতি মূলত ক্ষমতাসীন দলগুলোর অঙ্গসংগঠন করে থাকে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের পক্ষে লড়াই করে থাকে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। যারা এই ঘৃণ্য কাজ করে সমগ্র ছাত্র সমাজকে গণতান্ত্রকি অধিকার হরণের চক্রান্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ জেগে উঠবেই।
রাইসুল ইসলাম নয়ন, যুগ্ম আহবায়ক, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদঃ
রাইসুল ইসলাম নয়ন বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই একটা দেশের জন্যে জরুরী তবে বর্তমানে আমাদের দেশে যেমন নোংরা ছাত্ররাজনীতি চলে তেমনটা নয়! ষাটের দশকের মতো স্বতন্ত্র ছাত্ররাজনীতি জরুরী! উন্নত অনেক দেশেই দেখা যায় যে ছাত্ররাজনীতি আছে তবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত হয়ে। কিন্তু আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্ররাজনীতি সাথে যুক্ত ছাত্রদের!
ছাত্ররাজনীতি হবে সাধারণত শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর। কিন্তু আমাদের ছাত্রনেতারা হলেন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীদের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর। যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্রসংগঠনগুলো কাজ করবে ততদিন পর্যন্ত এ অবস্থা চলতেই থাকবে! তাই আমি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে না তবে সিস্টেম টা পরিবর্তনের পক্ষে।
খাইরুল হাসান জাহিন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নঃ
খাইরুল হাসান জাহিন বলেছেন, আবরার হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, ঠিক তখনই সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে বিভৎসভাবে খুন করা হয়েছে পাঁচ বছরের শিশু তুহিনকে। আমরা এমন একটা সময়ে আছি, যেখানে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট খুব স্বাভাবিক নিত্ত-নৈমিত্তিক ঘটনা।
পুরো সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে এতো নোঙরা, কলুষিত সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় তার বাইরে থাকবে তা আশা করা যায় না। শহরে আগুন লাগলে, সে আগুন দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এই পঁচা-গলা সমাজ, দুর্গন্ধময় নীতির বাইরে না যেতে পারলে এসবের পুনরাবৃত্তিই হবে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধই সমাধান না। দেশের মানুষের সামাজিক- অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শিক্ষাখাতের বাজেট, নারী-শিশুর ওপর নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা এসব কিছু সামাজিক ব্যবস্থার সাথেই যুক্ত।
আর সামাজিক ব্যবস্থাকে বদলাতে হলে আপনাকে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিটাকেই বদলাতে হবে। যতদিন রাষ্ট্র কাঠামো আছে, ততদিন রাজনীতি আছে। আর এই রাজনীতিতে সবচেয়ে তরুণ, সতেজ, সজীব প্রাণগুলো থাকা আশার কথা, সম্ভাবনার কথা।
কিন্তু এই তরুণ, সতেজ আর সম্ভাবনা গুলো কিভাবে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে যায়, কিভাবে অন্ধকারে হারিয়ে যায় সে দিক গুলো খুঁজেন। সে সব জায়গায় আঘাত করুন। যে তরুণটি স্বপ্ন দেখে, যে নিজের দেশের সম্পদ বিদেশীর কুক্ষিগত হওয়ার প্রতিবাদ করতে জানে, যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে চিৎকার করে তার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েন না। বরং যে সকল ব্যক্তি, সংগঠন এসব খুন-হত্যার সাথে জড়িত ও যারা তাদের মদদ দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনুন।
আসলেই কি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলেই এসকল সমস্যা সমাধান হবে? নাকি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নেপথ্যে কোন রাজনীতি রয়েছে? কোন কুচক্রী মহল কি জেগে উঠেছে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব সংকটে ফেলার জন্য? এসকল প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ছাত্র নেতাদের মাথায়? তারা কেউ ই চান না ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক বরং ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক গাইড লাইনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর প্রতিই জোর দিয়েছেন সকলে।
ঢাকা, ১৮ অক্টোবর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: