লাইভ প্রতিবেদক: পাপ কাউকে ছেড়ে দেয় না। বলা হয়ে থাকে যে কোন হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ রেখে যায় খুনিরা। এই কথাটি লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের ব্যাপারে আরো একবার প্রমাণিত হলো। এম এ আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের ব্যানারের আড়ালে নানান আকাম-কুকাম করে বেড়াতেন।
এদিকে এম এ আউয়ালসহ তিনজনকে চার দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট নিবানা খায়ের জেসী শুক্রবার এই আদেশ দেন। রাজধানীর পল্লবী এলাকার যুবক সাহিনুদ্দিন (৩৩) খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ওই ৩ জনকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাবেক সাংসদ আউয়ালসহ তিনজনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত আউয়ালসহ তিনজনের চার দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে নেওয়া অন্য দুই আসামি হলেন নূর মোহাম্মাদ হাসান (১৯) ও জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবু (২৭)।
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার ভৈরব থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি এম এ আউয়ালকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এদিকে সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি মো. মানিক র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, গত রোববার বিকেলে রাজধানীর পল্লবীর ডি–ব্লকের ৩১ নম্বর রোডে দুই তরুণ দুই পাশ থেকে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছেন। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটে পড়েন। এরপর হামলাকারীদের একজন চলে যান। অন্যজন ওই ব্যক্তির ঘাড়ে কোপাতে থাকেন মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত। নিহত ব্যক্তি পল্লবী এলাকার যুবক সাহিনুদ্দিন।
র্যাব বলছে, এ খুনের মূল পরিকল্পনাকারী লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। তাঁর নির্দেশে স্থানীয় সন্ত্রাসী মনির, মানিক, সুমন ব্যাপারী, হাসানসহ অন্যরা ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে রামদা ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করেন। এরপর সুমন মুঠোফোনে সাবেক এমপি আউয়ালকে জানান, ‘স্যার, ফিনিশ।’ মুঠোফোনের কলরেকর্ড পরীক্ষা করে র্যাব এ তথ্য পেয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানায়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জমিজমার বিরোধে গত ১৬ মে দুপুরে মো. সাহিনুদ্দিনকে সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যা মামলার ১নং আসামি ছিলেন এম এ আউয়াল। তাকে ভৈরবে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কে ওই এম. এ. আউয়াল:
সাবেক এমপি আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে পরের বছর ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। বর্তমানে তিনি দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে তরিকত ফেডারেশনের হয়ে সংসদ সদস্য হন এম. এ. আউয়াল। দলীয় গঠনতন্ত্রের ২৪ এর উপধারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নিয়ম বর্হিভূত কর্মকান্ডের কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
পুলিশ জানায়, সাবেক এমপি ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল লক্ষীপুরে নানান অপকর্ম করে বেড়াতেন। সরকারের আশকারা পেয়ে তিনি লোকজনকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করতেন। তরিকত ফেডারেশন সবই জানতো কিন্তু তার দাপটের কারণে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। কিন্তু ধরা খেয়ে যায় ঢাকায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর-১২ নম্বরের সিরামিকের মধ্যে এক বিঘার বেশি জমির মালিক ছিলেন নিহত যুবক মো. সাহিনুদ্দিন ও তার স্বজনেরা। জমিটির কিছু অংশ দীর্ঘদিন ধরে দখলে রেখেছিলেন সাবেক এমপি আউয়ালের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘হ্যাভিলি প্রপার্টি’। জমির মালিক একসময় তার জমি বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড দেন। এসময় জমিটি কেনার জন্য আউয়ালের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কথাবার্তাও হয়। কিন্তু দামে বনিবনা না হওয়ায় জমির মালিক তা বিক্রি করেননি। পরবর্তী সময়ে জায়গাটি আউয়াল জোর করে দখল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনি সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নিহত সাহিনুদ্দিন ও তার ভাই মাইনুদ্দিনকে প্রায়ই হুমকি-ধামকি দিচ্ছিলেন। সবশেষ তাদের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও দেন। সেই মামলায় সাহিনুদ্দিন ও তার ভাই মাইনুদ্দিন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। গত ২৭ রমজান তারা জামিনে মুক্ত হন। ঘটনার দিন ১৬ মে জমির মীমাংসার কথা বলে সাহিনুদ্দিনকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই যুবককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সাবেক এমপি আউয়ালের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তিনি কম মূল্যে এই জমি কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন জমির মালিকের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। এই ঘটনার পরই সন্ত্রাসীরা খুন করে সাহিনুদ্দিনকে।
নিহতের মা আকলিমা সাংবাদিকদের বলেন, জমির বিরোধেই তার ছেলেকে হত্যা করেছেন আউয়াল। তিনি (আউয়াল) চেয়েছিলেন, ছেলে হত্যা করলে জমি দখল করা তাদের জন্য সহজ হবে। ছোট ছেলেকে হত্যার পর এখন বড় ছেলে ও আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। যাতে আউয়ালের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নেই। তিনি আরো জানান, পৈত্রিকভাবে মিরপুর সিরামিকসের ভেতরে এক বিঘার বেশি পরিমাণ জমির মালিক ছিলেন তার শ্বশুর।
পরবর্তী সময়ে মালিক হন তার স্বামী জৈনুদ্দিন। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেরাই জমি দেখভাল করছিলেন। আর আউয়াল কম টাকায় এই জমি কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় তার দুই ছেলের নামে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদক মামলা দেয়া হয়। সবকিছুর জন্য তিনি সাবেক এমপিকে দায়ী করেন। আকলিমা বলেন, গত বছর আউয়াল ১০ কাঠা জমি কিনতে আমাদেরকে তার অফিসে ডেকে নিয়েছিলেন। তখন আমরা বলেছিলাম, জমির ন্যায্য দাম দেন, জমি দিয়ে দেব।
কিন্তু তিনি সব সময় গায়ের জোরে আমাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করেন। যতটুকু জানি, আউয়াল টাকা দিয়ে ২০/২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী পালেন। যারা সব সময় আমাদের জমি দখল করতে মরিয়া ছিল। আমার স্বামী মারা যাবার আগে তার নামেও সাতটা মামলা দিয়েছিল আউয়ালের লোকজন। এসময় তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান। জানা গেছে, ঘটনার দিন জমির বিরোধ মীমাংসার কথা বলে সাহিনুদ্দিনকে ডেকে নিয়ে যান সুমন ও টিটু নামে দুজন।
পরে পল্লবীর সেকশন-১২ বøক-ডি এর ১২ নম্বর এলাকার একটি গ্যারেজে ঢুকিয়ে তাকে রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই দৃশ্য কেউ একজন মোবাইলে ধারণ করে। যা দেখে মনে হবে- সেই বিশ্বজিতের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। এই মামলায় এজাহারনামীয় ২০ আসামি হলেন- সাবেক এমপি আউয়াল, আবু তাহের, মো. সুমন, মো. মুরাদ, মো. মানিক, মো. মনির, মো. শফিক, মো. টিটু, আব্দুর রাজ্জাক, মো. শফিক, কামরুল, কিবরিয়া, মো. দিপু, মরন আলী, লিটন, আবুল, সুমন ওরফে নাটা সুমন, কালু ওরফে কালা বাবু, বাবু ওরফে বাইট্টা বাবু এবং বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু।
দুই যুবক গ্রেফতার :
ডিএমপির মিডয়া উইংয়ের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর পল্লবী ও রায়েরবাগ এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা মিরপুর জোনাল টিম। রোববার (১৬ মে) বিকেল ৪টায় সন্ত্রাসীরা জায়গা-জমির বিরোধের বিষয়ে মীমাংসার কথা বলে সাহিনুদ্দিনকে সেকশনের ডি-ব্লকের একটি বাড়ির সামনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। প্রকাশ্য দিবালোকে রোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ভিকটিমের মায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত সোমবার পল্লবী থানায় হত্যা মামলা করা হয়। গত বুধবার থেকে মামলাটির তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা মিরপুর জোনাল টিম।
তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকা থেকে হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। সুমনের দেয়া তথ্য মতে, পল্লবী থানার স্কুল ক্যাম্প কালাপানি এলাকা থেকে অপর অভিযুক্ত রকিকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনাটি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃস্টি করেছে।
ঢাকা, ২১ মে (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এআইটি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: