লাইভ প্রতিবেদক: যাদের আমি পড়ালাম, লিখালাম তারাই আমার কব্জি কেটেছে। ১২ বছর যাদের পাঠদান করেছি তারাই আমার সর্বনাশ ডেকে আনলো। আমরা এই সমাজেই বসবাস করছি। যেখানে আমার মত সাধারণ শিক্ষকের কোন নিরাপত্তা নেই। যাদের জন্যে শ্রম-ঘাম দিলাম তারাই আমার প্রিয় হাতের কব্জিটা কেটে নিয়েছে। আমি আর কি করতে পারি। এমন কথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কলেজশিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন (৫২)। একই সাথে বললেন আমি মাজলুম। আমার উপর জুলম করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) হসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বিছানায় শুয়ে কবজি বিচ্ছিন্ন হওয়া হাতের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন কলেজশিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন (৫২)।
তিনি বললেন আমি যে হাতে লিখে শিক্ষার্থীদের পড়াতাম সেই ডান হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে পেশাদার সন্ত্রাসীরা। এরা ধারালো অস্ত্রের কোপে এই ক্ষতি করেছে। এই শিক্ষকের কাছে সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, তিনি যে ছাত্রদের পড়িয়েছেন তারাই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার কবজি বিচ্ছিন্ন করেছেন। তার বুকফাটা কান্না আর ভাষ্য যাদের আমি পড়িয়েছি, শিখিয়েছি এরাই আমার হাতটা কেটে দিয়েছে। এনিয়ে গোটা এলাকায় তোলপাড় চলছে। কিন্তু কে নেবে এই সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব। কে করবে বিচার। এমন হাজারো প্রশ্ন এলাকায় নিরিহ মানুষের। এরা প্রভাবশালী। এরা রাজনীতি করে।
জানাগেছে আহত শিক্ষক কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রাম আলাউদ্দিন আহম্মেদ কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রায় ১২ বছর ধরে ওই কলেজে শিক্ষকতা করছেন। কুপিয়ে কবজি বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় কুমারখালী থানায় তোফাজ্জেল হোসেনের বড় ছেলে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তবে সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা এখন অনেকটাই কাবু। কথন কি হয়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার (৩১ মে) দুপুরে কলেজ থেকে বের হয়ে বংশীতলা এলাকা দিয়ে শহরে যাচ্ছিলেন তোফাজ্জেল হোসেন। এ সময় তাকে কয়েকজন সন্ত্রাসী ঘিরে ধরে পেটাতে থাকেন। তিনি সেখান থেকে দৌড়ে কয়েক শ গজ দূরে নির্মাণাধীন একটি সেতুর ওপর যান। সেখানে অবস্থান নেওয়া আরও ১০-১২ জন সন্ত্রাসী রামদা-চাপাতি দিয়ে তাকে কোপাতে থাকেন। এ সময় তার ডান হাতের কবজি থেকে ওপরের এক ইঞ্চিসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তার পরেও ওই সন্ত্রাসীরা শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেনের পিঠেও এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর হামলাকারীরা চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তোফাজ্জেলকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি কোপে তার বাঁ পাজর, মেরুদণ্ডের হাড়সহ শরীরের ১৩টি স্থানে গুরুতর জখম হয়। কুষ্টিয়া জেলারেল হাসপাতালে অস্ত্রোপচার শেষে ওই দিন রাতেই ঢামেকে নিয়ে আসা হয় ওই শিক্ষককে।
এদিকে ঢামেক হাসপাতালের পুরোনো ভবনের নিচতলার ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে তোফাজ্জেল হোসেনের। শুক্রবার (৩ জুন) ওই ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বিছানায় তোফাজ্জেল হোসেনকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। জ্ঞান ফিরলেও কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। খুব ধীরে ধীরে দু-একটি কথা বলছেন তিনি। কিন্তু তার দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছিলো।
কান্নাভেজা কন্ঠে কলেজশিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ১০ থেকে ১২ জন মিলে রামদা আর চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে। আমিতো কোনোদিন কারও ক্ষতি করিনি। দীর্ঘ ১২ বছর যে হাত দিয়ে লিখে শিক্ষাদান করে আসছি সেই হাত কেটে দিল সন্ত্রাসীরা! যারা হামলা করেছেন তাদের সবাইকে আমি চিনি। এলাকায় তারা চুরি, ডাকাতি করেন। আহত এই শিক্ষক বলেন, সবচেয়ে কষ্টের কথা আমি যে ছাত্রদের শিক্ষা দিয়েছি তারাই আমাকে কুপিয়েছে।
হামলায় অংশ নেওয়া তিন-চারজন আমার সরাসরি ছাত্র। যাদেরকে এই হাতে শিক্ষা দিলাম সেই ছাত্ররাই আমার হাতের কবজি কেটে দিয়েছে! এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবারও শিক্ষকতায় ফিরে যেতে চান বলে জানান এই শিক্ষক। তোফাজ্জেল হোসেনের ছোট ছেলে নাজমুস হাসিব বলেন, আমার বাবা খুব সহজ-সরল একজন মানুষ। তিনি কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারেন না।
সন্ত্রাসীরা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এবং তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে আমার বাবার আজকের এই পরিস্থিতি। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। এদের দুস্টান্তমূলক শাস্তি না হলে মানুষ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঢাকা, ০৩ জুন (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//বিএসসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: