Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষক মাহবুবুল হককে পড়াতে দিন

প্রকাশিত: ২১ আগষ্ট ২০১৭, ১৯:০১

আমরা হতবাক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক সালমনের পর শিকার হলেন মাহবুবুল হক ভূঁইয়া। ঘটনাস্থল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি শেষে মাহবুবুল তার ছাত্রদের অনুরোধে কিছুটা সময় দিয়েছিলেন। আর তাতেই বেধেছে যত বিপত্তি।

মাহবুবুল হক ভূঁইয়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের লেকচারার ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান। শোক দিবসে শিক্ষার্থীদের অনুরোধে পড়া বুঝিয়ে দেওয়াকে ‘ক্লাস’ নেওয়ার অপবাদ দিয়ে তাকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা হতভম্ব, মর্মাহত ও শঙ্কিত। আমরা আরও বেশি অবাক হয়েছি মাহবুবুল ও তার শিক্ষার্থীদের বক্তব্য ও প্রাথমিক কোনো তদন্তের তোয়াক্কা না করেই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এক মাসের ছুটিতে পাঠিয়েছে। প্রায় একই সময়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিষয়টি হাস্যকর করে তোলা হয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অবিবেচনাপ্রসূত ও আইনবহির্ভূত এসব পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

মাহবুবুল একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অন্যদের মতো তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং শ্রদ্ধা জানান। পরে কয়েকজন শিক্ষার্থীর অনুরোধে এবং নিজের কক্ষে বসার মতো পর্যাপ্ত স্থান না থাকায়, একটি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যাবলি শুনে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন। ছুটির দিনে একজন শিক্ষকের এমন প্রচেষ্টা কোথায় সাধুবাদ পাবে তা না, উল্টো শুরু হলো তাকে হেনস্তা করা।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী শোক দিবসে ‘ক্লাস’ নেওয়ার অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীদের সামনে মাহবুবুলকে অপমান-অপদস্থ করেন। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। পুরো ঘটনা তারা ভিডিও করে ফেসবুকেও ছড়িয়ে দেন। তাদের করা ভিডিওই তাদের সমস্ত অন্যায়, শিক্ষককে অপমান এবং শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার সাক্ষ্য বহন করে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাহবুবুলের বহিষ্কারের দাবিতে ভিসি বরাবর আবেদন করেন এবং ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করতে থাকেন। অন্যদিকে মাহবুবুল ফেসবুক পোস্ট ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে জানান, ওই দিন তিনি কোনো ক্লাস নিচ্ছিলেন না। শিক্ষার্থীরাও ভিসির কাছে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ ভিসি বরাবর প্রতিবাদলিপি দিয়েছে।

আমরা ভেবেছিলাম, সবার বক্তব্য নিয়ে প্রশাসন একটি সিদ্ধান্তে যাবে। কিন্তু অন্য কারও কথার তোয়াক্কা না করে, ছাত্রলীগের একটি অমূলক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মাহবুবুলকে ছুটিতে পাঠালেন ভিসি। তাও তিনি করলেন একক সিদ্ধান্তে, সিন্ডিকেটের কোনো সভা ডাকার প্রয়োজনই বোধ করলেন না। ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী তাহলে ছাত্রলীগের আইন দ্বারা পরিচালিত?

আমরা মনে করি, একজন শিক্ষক দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই শিক্ষক। আর তাই ১৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে মাহবুবুল হক কোনো অন্যায় বা অপরাধ করেননি। এটা কোনোভাবেই শোক দিবস বা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননা নয়, বরং তা প্রকৃত ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন। কারণ, বঙ্গবন্ধু এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ কাজ ও দায়িত্বে নিবেদিতপ্রাণ হবেন। শোক দিবসের আনুষ্ঠানিকতার পর মাহবুবুল যা করেছেন তা বরং প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা।

অথচ দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, ছাত্রলীগের অন্যায্য দাবিতে গা ভাসিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম না মেনে তদন্ত কমিটি করেছে, এমনকি তদন্ত ছাড়াই তাকে ছুটিতে পাঠিয়েছে। আমরা সমস্বরে এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

আমাদের প্রশ্ন, কোনো রকম আইনকানুন না মেনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন পদক্ষেপ নিল কেন? কেন মাহবুবুলের সঙ্গে ছাত্রলীগের অভিযোগ বিষয়ে আলোচনা করা হলো না? কেন সেদিন পড়তে চাওয়া শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি আমলে নিলেন না উপাচার্য? শিক্ষককে অপমান করা এবং শিক্ষার্থীদের হুমকি প্রদানের বিষয়টিকে কর্তৃপক্ষ কেন গুরুত্ব দিল না? তাহলে কি আমরা ভাবব, কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় চালায় আসলে ছাত্রলীগ?

ঘটনার পর থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী ফেসবুকে মাহবুবুলকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত পুলিশ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার শিক্ষকের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিষয়টি একই সঙ্গে লজ্জাজনক ও আতঙ্কের।

সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে চরম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মাহবুবুল এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফোরাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তার চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু পরিষদসহ বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট অনেকে অভিযোগ করছেন, তাকে ‘শায়েস্তা’ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদকে ম্রিয়মাণ করার জন্যই শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করেছে ছাত্রলীগ এবং প্রকারান্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আমরা কোনো চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র বুঝতে চাই না। আমরা মনে করি, মাহবুবুলকে অন্যায়ভাবে ছুটিতে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ‘একাডেমিক ফ্রিডম’ বলে যে কথাটি চালু আছে, তা খর্ব করা হয়েছে। কার্যত এর মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়কে তীব্র অপমান করা হয়েছে।

আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাহবুবুলকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করবে এবং তাকে স্বাভাবিক নিয়মে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেবে। আর যারা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে ‍বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেবে। অন্যরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন বলে আমরা আশা করি।

সবশেষে সবার প্রতি আমাদের একটাই দাবি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মাহবুবুল হক ভূঁইয়াকে পড়াতে দিন।


[বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ]


ঢাকা, ২১ আগস্ট (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//জেএন


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ