Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

‘সম্মান প্রথম বর্ষ থেকে গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে’

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বার ২০১৬, ০২:০৬

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রথিতযশা শিক্ষক বিজ্ঞানী ডঃ বেলাল হোসাইন। যিনি ইতোমধ্যে দুইটি নতুন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কার করে পুরো বিশ্বে আলোচনায় এসেছেন। তার একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রেজাউল করিম সোহাগ। উঠে এসেছে তার বর্তমান ব্যস্ততা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পারিবারিক বিষয়।

ক্যাম্পাসলাইভ : স্যার কেমন আছেন?

ডঃ বেলাল : ভালো, তুমি কেমন আছো?

ক্যাম্পাসলাইভ : বর্তমানে কি নিয়ে ব্যস্ত আছেন?

ডঃ বেলাল : বর্তমানে এমফিপোড ও পলিকিটের আরো কিছু প্রজাতি নিয়ে কাজ করতেছি, এগুলোর কাজ শুরু হয় আরো প্রায় ১ বছর আগে। একটার কাজ আগামী ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে আশা করি।

ক্যাম্পাসলাইভ : আপনার এই যে নতুন প্রজাতি আবিষ্কার এগুলো মানব কল্যাণে কিভাবে অবদান রাখবে?

ডঃ বেলাল : সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীতে যতো প্রাণী সৃষ্টি করেছেন সব কিছুই মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। আমি কাজ করি মূলত এক্যুয়েটিক (জলীয়) ইকো সিস্টেম নিয়ে, এক্যুয়েটিক ইকো সিস্টেম এ সবচেয়ে নিচের স্তরের প্রাণী হলো ব্যাক্টেরিয়া আর উপরের স্তরের প্রাণী বলা যায় মাছ। এরা একে অপরের উপর খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল। যেমন বড় মাছ নির্ভরশীল ছোট মাছের উপর, ছোট মাছ নির্ভরশীল অন্য কোনো ছোটো মাছ বা জুয়োপপ্ল্যাঙ্কটন (প্রাণিকনা) এর উপর জুয়োপ্ল্যাঙ্কটন নির্ভরশীল ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এর উপর।আবার সমুদ্রের নীচে যদি পর্যাপ্ত পুষ্টি না থাকে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জন্মাবে না, এটা একটা চেইন। এই চেইনের কোনো একটি উপাদান যদি না থাকে খাদ্যচক্র ভেঙ্গে পড়বে এবং জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।


ক্যাম্পাসলাইভ : আপনি যে দুইটা প্রাণী আবিষ্কার করেছেন সেগুলো নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে ?

ডঃ বেলাল : না, এখনি কোনো গবেষণা হচ্চে না। এটা অন্য বিভাগের কাজ, যারা এগুলার ব্যাবহার নিয়ে কাজ করেন তাদের। আমার কাজ হলো আবিষ্কার করা। প্রথম যে প্রাণীটা আবিষ্কার হয়েছে বাংলাদেশ উপকূলে এটা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।

ক্যাম্পাসলাইভ : নোবিপ্রবিতে গবেষণা খাতে তেমন বরাদ্দ থাকে না বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?

ডঃ বেলাল : নোবিপ্রবিতে গবেষণায় খুবি কম অর্থ বরাদ্দ থাকে এটা দুঃখজনক তবে এই বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বছর ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আশা করি সামনের বছর আরো বেশী বরাদ্দ দেওয়া হবে।

ক্যাম্পাসলাইভ : নোবিপ্রবিতে বর্তমানে কোনো গবেষণা প্রকল্প কি চলতেছে?

ডঃ বেলাল : শিক্ষকদের পৃথক প্রকল্প চলছে, বড় মাপের অর্জনের জন্য যে ধরনের গবেষণা দরকার সে গুলা হচ্ছে না। বড় ধরনের কোনো বাজেট না থাকায় এটা সম্ভব হচ্ছে না।

ক্যাম্পাসলাইভ : প্রশাসনের সাথে বড় আকারের বাজেট নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে?

ডঃ বেলাল : আমাদের ভিসি স্যার, (ডঃ এম অহিদুজ্জামান) আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন ভবিষ্যতে বড় আকারের বাজেট দিবেন গবেষণার জন্য। ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বড় বড় অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নোবিপ্রবিতে কোনো বড় আকারের বরাদ্দ আসলে বড় কোনো গবেষণা প্রকল্প নেওয়া যাবে।

ক্যাম্পাসলাইভ : বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সেশনজট রাজনৈতিক সমস্যা সহ বিভিন্ন সমস্যা গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করে কিনা?

ডঃ বেলাল : এটা ঠিক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ যদি শান্ত না থাকে তাহলে গবেষণার পরিবেশ ঠিক থাকে না ফলে গবেষণা কার্যক্রম চালানো যে কারো জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

ক্যাম্পাসলাইভ : বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাগর উপকূলে অবস্থিত, এটা আপনার জন্য অসুবিধা কিনা?

ডঃ বেলাল : আমার বিষয় হলো মৎস ও সমুদ্র বিজ্ঞান, আমি সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করি, বিশ্ববিদ্যালয় উপকূলে হওয়াতে আমার জন্য যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে, আমি চাইলেই সমুদ্রে যেতে পারি, বিশেষ করে নোয়াখালী হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও সন্দীপে সহজে গবেষণা কাজ করতে পারি। তবে অসুবিধা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না।

ক্যাম্পাসলাইভ: বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কেমন পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়?

ডঃ বেলাল : এটা আসলে নির্ভর করে পরিবেশের উপর। বাহিরের দেশে যা হয় যখন একজন শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন থেকে তাদের কে গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলা হয়, উৎসাহ দেওয়া হয় এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এই রকম সুযোগ সুবিধা পায় না, আমি মনে করি আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের কে ১ম বর্ষ থেকে গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলা উচিৎ।

ক্যাম্পাসলাইভ : বর্তমানে বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?

ডঃ বেলাল : এটা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন, গত বছর ৫ম ছিলো এবার চতুর্থ, দিন দিন বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মাছ রপ্তানি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে বলা যায় চিংড়ির কথা।

ক্যাম্পাসলাইভ : বাংলাদেশে বর্তমানে মাছ নিয়ে কেমন গবেষণা হচ্ছে?

ডঃ বেলাল : বাংলাদেশে কিছু মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র আছে তারা গবেষণা করছে পাশাপাশি যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য বিভাগ রয়েছে তারা গবেষণা করছে তবে জাতীয় ভাবে কোনো মৎস গবেষণা কেন্দ্র নেই । এই গবেষণার ফলেই মূলত মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিঠাপানির অনেক নতুন প্রজাতির মাছ আবিষ্কার করা হয়েছে এই ছাড়া দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

ক্যাম্পাসলাইভ : বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে কতদূর যেতে পারবে বলে মনে হয়?

ডঃ বেলাল : আশাকরি বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে একদিন শীর্ষস্থান অর্জন করবে।

ক্যাম্পাসলাইভ : স্যার আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

 

ডঃ বেলাল : আমি আসলে এখন কাজ করছি ওশান স্পিসিপিক নিয়ে এটাকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের টু ইন ইফেক্ট বা যমজ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারন আমরা জানি তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, এটা সবাই জানে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় প্রভাব হচ্ছে সমুদ্রের পানির পিএইচ কমে যাওয়া ফলে এসিটেডি (অম্লতা) বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামুদ্রিক অনেক প্রাণী খোলস দ্বারা আবৃত, এই খোলস তৈরি হয় ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে। এসিটেডি বৃদ্ধি পেলে এই খোলস গুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যাবে কারন ক্যালসিয়াম কার্বনেটের ভিতর এসিড পড়লে সেটা ক্ষয় হয়ে যায়। বর্তমানে সমুদ্রের পানির পিএইচ হচ্ছে ৮.২। ১০০ বছর আগে ছিলো ৮.৩। তার মানে গত ১০০ বছরে পিএইচ ০.১ কমে গেছে, এই ০.১ কমে যাওয়ার ফলে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ঠিকমত খোলস গঠন করতে পারছেনা।

 

সমুদ্রের পানির পিএইচ যদি আগামী ১০০/২০০ বছরে আরো কমে ৮.১/৮.০ হয়ে যায় তাহলে এই সকল প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে যা জীব বৈচিত্র্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি আমার এই কাজের সাথে যেহেতু বেনথিক অর্গানিজম (সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী জীব) জড়িত, তাই ঐ মূল কাজ করতে গিয়ে পাশাপাশি এটা চলে আসছে। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল খুবি অবহেলিত, এখানে তেমন গবেষণা হয় নাই। তাই আমি যদি আরো ৩০/৪০ বছর এই গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারি আরো ৩০/৪০ টা নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করতে পারবো।

ক্যাম্পাসলাইভ : স্যার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

ডঃ বেলাল : বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের যে পার্থক্য তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান তৈরি করবে আর কলেজে সেই জ্ঞান পড়ানো হবে। যদি দঃ কোরিয়ার কথা বলি, দঃ কোরিয়া ৬০ এর দশকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছিলো কিন্তু আজকে দঃ কোরিয়া সারা পৃথিবীর কাছে একটি রোল মডেল। এর কারন হলো তারা শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। আমাদের দেশকেও এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা গবেষণা ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিনিয়োগ করা উচিৎ।

ক্যাম্পাসলাইভ : বর্তমানে যে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক চলছে তা হলো রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আপনি কি মনে করেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দর বনের জীব বৈচিত্র্য উপর কি প্রভাব পড়তে পারে?

ডঃ বেলাল : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলে মৎস্য উপাদানের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এই ছাড়া সুন্দর বনের ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতবড় ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীর আর কোথাও নেই, এটা শুধু এই দেশের নয় সারা বিশ্বের সম্পদ। তাই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার আগে সরকারের উচিৎ শুধু জাতীয় নয় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া।

ক্যাম্পাসলাইভ : স্যার এবার আপনার কিছু ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাই, আপনার পরিবার সম্পর্কে যদি বলতেন?

ডঃ বেলাল : আমার স্ত্রী শামীম রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্য বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে, ২০১০ সালে পুনরায় জার্মানি তে এমএস করতে যায়, ২০১২ সালে শেষ করে আমার সাথে ব্রুনাইতে ছিলো। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছে মলিকুলার ইকোলজির উপর। আমার একমাত্র মেয়ে ৬ বছর বয়স অস্ট্রেলিয়াতে গ্রেড ওয়ানে পড়ে।
ক্যাম্পাসলাইভ : আপনি তো ব্যস্ত থাকেন গবেষণা নিয়ে পরিবার থেকে কেমন সমর্থন পান?
ডঃ বেলাল : পরিবার থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাই, আমার স্ত্রী যেহেতু উচ্চ শিক্ষিত তাই আমাকে গবেষণায় উৎসাহ দেয় সব সময়। তবে আমি ব্যস্ত থাকায় পরিবার কে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না।

ক্যাম্পাসলাইভ : ভবিষ্যৎ তে কি বাংলাদেশেই থাকবেন নাকি বাহিরে থাকবেন?

ডঃ বেলাল : পিএইচডি শেষ করে আমার স্ত্রীর বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে, দেশের সেবা করার ইচ্ছা। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, তাই বাংলাদেশেই আশা করি থাকবো যদিও অস্ট্রেলিয়া ও ব্রুনাই থাকারো সুযোগ আছে।
ধন্যবাদ স্যার।

 


ঢাকা, ২৪ নভেম্বর (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)// এএসটি


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ