Azhar Mahmud Azhar Mahmud
teletalk.com.bd
thecitybank.com
livecampus24@gmail.com ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ১৬ই মে ২০২৪, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
teletalk.com.bd
thecitybank.com

আলোহীন জীবন যুদ্ধের অদম্য সৈনিক মতিন

প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারী ২০১৮, ০১:০৮

আমিনুর রহমান হৃদয়: ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আশরাফবাদ নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তাঁর। জন্মের পর থেকেই দু’চোখে দেখতে পান না তিনি। জন্মান্ধ হওয়ার কারণে প্রতিবেশীরাও তাঁকে ‘আতুঁড় ল্যাংড়া কানা, এরা পয়গাম্বরের দুশমন’ এমন নানা কথা বলে কটুক্তি করতো।

চোখে না দেখতে পাওয়ায় কেউ বন্ধুত্বও করতো না। একা একা পথ চলতে গিয়ে অনেক সময় দুষ্ট লোকেরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত তাঁকে। তারপরেও আলোহীন জীবন যুদ্ধে কোন বাঁধায় দমিয়ে রাখতে পারে নি তাঁর পথচলা। সব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি।

বলছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়ুয়া দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মতিন মিয়ার কথা। সম্প্রতি এক আড্ডায় কথা হয় আলোহীন জীবন যুদ্ধের এই অদম্য সৈনিকের সাথে। কথায় কথায় তিনি জানালেন, বাবা আলী মিয়া পেশায় একজন প্রান্তিক কৃষক আর মা নূর জাহান বেগম গৃহিনী।

দুই ভাই- দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। মায়ের কাছে শুনেছিলেন জন্মের পর তাঁর বয়স যখন ৭দিন। তখন পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পেরেছিলেন সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না। তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।

স্থানীয় চিকিৎসকরা ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য বলেন। ৪০ দিনের মাথায় চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এলে চিকিৎসকরা চক্ষু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর জানিয়ে দেন সে কোনদিনই চোখে দেখতে পারবেন না। এরপর আলোহীন চোখ নিয়েই বয়স বাড়তে শুরু করে মতিনের।

তাঁর বয়স যখন ছয় বছর। তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারী সংস্থা মতিনের খোঁজ পায়। তাঁর বাবা-মাকে বুঝিয়ে মতিনকে স্কুলে ভর্তি করায় সেই সংস্থাটি। ব্রেইল পদ্ধতিতে শুরু হয় মতিনের শিক্ষাজীবন।

এরই মধ্যে মতিনের বাবা বিদেশে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমান। শিক্ষাজীবনে মতিনের পথচলার সঙ্গী হোন তাঁর নানা কালুমিয়া বেপারী। মতিন মিয়া বলেন, ‘আমার নানা আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতো আবার স্কুল শেষে তিনি নিয়ে আসতেন। এভাবেই আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

ছোটবেলায় খুব দুষ্ট ছিলেন এই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চোখে না দেখতে পেলেও গাছে উঠতে পারতাম, সাঁতার কাটতে পারতাম। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনার শিকারও হতাম। মায়ের কাছে এজন্য গালিগালাজও শুনতে হয়েছে। আমার কখন কি হয়? এই নিয়ে মা দুশ্চিন্তায়ও থাকতেন।

মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয় মতিন। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই মেহেদী হাসান নামে এক বন্ধুসহ আরো বেশ কয়েকজন বন্ধু তাঁকে পড়াশোনায় সহযোগিতা করে আসছেন বলে জানান তিনি।

ক্লাসের পড়া মোবাইলে রেকডিং করে দেয় বন্ধুরা আর সেই রেকর্ড শুনে শুনে পড়া আয়ত্ত করেন তিনি। একজন শ্রুতিলেখকের সহযোগিতায় পরীক্ষা দিয়ে থাকেন দৃষ্টিহীন এই শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর পড়ছেন ইতিহাস বিভাগে।

সেই সাথে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এইভাবেই আলোহীন জীবনে এগিয়ে চলেছে তাঁর শিক্ষা জয়ের গল্প। মতিন তাঁর আলোহীন জীবনে একা একা পথ চলতে গিয়ে বাঁশিকেই নিজের সঙ্গী করে নিয়েছেন। মধুর সুরে বাঁশি বাজিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন বাঁশি মতিন হিসেবে।

তিনি বলেন,‘কেউ আমাকে না বুঝলেও বাঁশি আমাকে বুঝে। মন খারাপ থাকলে বাঁশি বাজাই। বাঁশিই আমার নি:সঙ্গতার সঙ্গী।’ মতিনের বাঁশি সুর শুনতে এখন প্রায় সময়ই ভিড় জমায় তরুণ-তরুণীরা।

মতিন বলেন, ‘নিজের নি:সঙ্গতা দূর করতে বাঁশি বাজালেও এখন অনেকেই আমার বাঁশির সুর শুনতে আসে। ভালোই লাগে। আমার বাঁশির সুরেই এখন অনেকে আমার কাছে আসে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটিতে বংশীবাদক হিসেবে বাঁশি বাজিয়েছি।

এছাড়াও বুয়েট, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবির একাধিক অনুষ্ঠানে বাঁশির সুর পরিবেশন করেছি।’ তাঁরা বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, ক্লাসিক্যাল বাঁশি, বেলুন বাঁশিসহ বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন সাইজের ১৬টি বাঁশি তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। কিছু বাঁশির দাম বেশি হওয়ায় টাকার অভাবে কিনতে পারছেন না, তবে টাকা হলেই সেইসব বাঁশি কিনে ফেলবেন বলে জানান বাঁশি মতিন।

এই আলোহীন জীবনে সীমাবদ্ধতা কথা বলতে গিয়ে মতিন বলেন, ‘আমার বন্ধুরা ইচ্ছে করলেই যে কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারে। ইচ্ছে করলেই যে কোন বই পড়তে পারে। আমার মতো দৃষ্টিহীনরা ইচ্ছে করলেই যে কোন লেখকের বই পড়তে পারি না, যে কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারি না। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ ভবিষ্যতে সমাজসেবামূলক কাজের সাথে নিজেকে নিয়োজিত রেখে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান মতিন।

 

ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)//এমআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর


আজকের সর্বশেষ